কৃতজ্ঞতা
একবার তিনি কি একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার ঘরে পায়চারি করছিলেন। বন্দিতা তখন ছোট। তার জ্যাঠা শশুর মশাই তাকে শিখিয়েছেন স্বামীর সেবা করতে। সে রোজ দেখত বিহারী পেয়ালা করে চা নিয়ে যান পড়ার ঘরে। বিহারীর মানা করা সত্তেও সে তুলে নেয় চায়ের পেয়ালা সেদিন।
“এরকম করবেন না গিন্নিমা” ভয় আতকে ওঠে বিহারী। “ব্যারিস্টার বাবুর কাজের সময় তিনি কথা বলা, বিরক্ত করা পছন্দ করেননা। উনি ক্ষুব্ধ হলে আমার চাকরি যাবে।” বন্দিতা তার কথায় কান না দিয়ে, গরম চায়ের পেয়ালা নিয়ে প্রবেশ করে পড়ার ঘরে। সেদিন তার প্রথম পড়ার ঘরে পদার্পণ। অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, কত বই রাখা সারি সারি আর কত মেডাল। সেই সব কিছুরই মাহাত্ম্য বোঝেনা সেদিন সে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই, আগে পেয়ালাটা রাখে, তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। অনিরুদ্ধ গম্ভীর হয়ে মুখ তুলে চায় । তার নূপুরের আওয়াজ যেন বিব্রত করে তাকে।
“কিছু চাই তোমার?” তার জিজ্ঞাসাতে মাথা নাড়ে বন্দিতা, কেমন বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব তার।
“এগুলো কি?” তার টেবিলের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে বন্দিতা।
“উইল।” ভ্রূকুটি বন্দিতার মুখে।
“উই পোকা শুনেছি, উইল আবার কি?” বিহারী ততক্ষণ ঘরের বাইরে ভয় ভয় দাড়িয়ে ছিল। অনিরুদ্ধকে নিজের হাতের বইটা নামিয়ে রাখতে দেখে পালায় সে। আজ নির্ঘাত দুঃখ আছে তার কপালে, কিন্তু তারও আগে, জমিদার গিন্নির কপালে।
অনিরুদ্ধের গম্ভীর মুখ দেখে বন্দিতা ঢোক গেলে, রেগে গেলেন নাকি তার স্বামী? অনিরুদ্ধ প্যান্টালুনের পকেটে হাত দিয়ে এসে দাঁড়ায়ে তার সম্মুখে। প্রশ্ন করলে কোনদিন রেগে গিয়ে থামিয়ে দেয়না সে। বরং খুশি হয় বন্দিতার আগ্রহে।
“উইল কথাটা বাংলা না, ইংরিজি।” বোঝায় সে, “মানে... ইচ্ছা বলতে পারো।” বন্দিতার মনের অন্ধকার যে দূর হয়নি, তা সে বোঝে তার ভ্রূকুটি দেখে। “ধরো কেউ অসুস্থ, মারা যাবেন। তিনি কাউকে তার বাড়ি জমি জমা সব দিয়ে যেতে চান... “ থেমে তাকায় সে, বন্দিতা মাথা নাড়ে। “তবে ব্যারিস্টার ডেকে একটি কাগজে সেসব লিখে সই করিয়ে নেওয়া হয়, সেটাকে উইল বলে।”
“বাপরে।” বিস্মিত হয় বন্দিতা, তার আলতা পরা হাত চলে আসে মুখের উপর।
“কিন্তু আমাদের পাড়ার বুড়ো গোপাল দাদু যেবার মরল , ওর ছেলেদের ডেকে তো বলে দিল কে কি পাবে, কই কোনো ব্যারিস্টার তো ডাকেনি।” মৃদু হাসে অনিরুদ্ধ।
“সে তার ইচ্ছা। সে জানত তার ছেলেরা তার কথা শুনবে, সম্মান রাখবে, সবাই তো জানেনা। তাই উইল রাখা ভালো, কবে কে বলবে যে এমন তা বলেনি, কোনো প্রমাণ আছে?” মাথা নাড়ে বন্দিতা। হাবভাব এমন যেন কত বুঝেছে।
“প্রমাণ।” বিড়বিড় করে আওড়ায় সে।
“হ্যাঁ, প্রমাণ ছাড়া কারুর কিছু বিশ্বাসযোগ্য না, বুঝলে?” তার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলে অনিরুদ্ধ। বন্দিতা হাসে, “বুঝলাম।” বাইরের ঘরের ঘড়িতে ঢং ঢং করে আওয়াজ হয়। বন্দিতা তখনো গুনতে জানেনা, কিন্তু ঘড়ির আওয়াজ অনুজাই নিজের দৈনিক কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়েছে সে, “দেখেছেন কি কান্ড ! আপনার ডাকাডাকিতে দেরি হয় গেলো বন্দিতার।” তার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেই অনিরুদ্ধ। সে মাথায় করাঘাত করে বলে ওঠে,
“ কি যে করেন আপনি, এদিকে বড় ঠাকুরপো এলেন বলে কলেজ থেকে।” দৌড়ে চলে যায় সে, অনিরুদ্ধ খানিকটা হচকচিয়ে দাড়িয়ে থাকে সেখানে। সে কখন ডাকলো বন্দিতা কে?
সেদিন রাতে যখন স্লেট পেন্সিলে তার লেখা অক্ষরের উপর হাত বোলাচ্ছে বন্দিতা হঠাৎ থেমে তাকায় সে অনিরুদ্ধের দিকে।
“আমি ভেবে নিয়েছি।” তার কথায় নিজের গল্পের বইটা থেকে চোখ তুলে তাকায় অনিরুদ্ধ। দুজনে মুখোমুখি বসেছে তারা বিছানার উপর, বাইরের ঘড়িটা আর একবার ঢং করলেই সেদিনের মত পড়া শেষ।
“কি আবার ভাবলে?”
“আমি উইল বানাবো।” তার কথায় হঠাৎ তাকায় অনিরুদ্ধ। “আমার যা আছে সবাইকে ভাগ করে দেব। আপনি বানিয়ে দেবেন আমার উইল?” হেসে ফেলে অনিরুদ্ধ। মাথা নাড়ে।
“আচ্ছা। কি আছে তোমার শুনি” হঠাৎ বিছানার বালিশের উপর কুনুই দিয়ে ভর দিয়ে, আধশোওয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে অনিরুদ্ধ। বন্দিতার চোখ জলজল করছে, ঠোঁটের কোণে হাসি। সারাদিন পর তার আলতা, সিঁদুরের টিপ ও সিঁথির সিঁদুর হালকা হয়ে গেলেও তাকে দেখে বিন্দুমাত্র ক্লান্ত লাগেনা।
“আমার পুতুলগুলো দিয়ে যাব বড় ঠাকুরপোকে, ওই শাড়ী, গয়না, ওগুলো সম্পূর্ণা দিদিকে, না না... “ হঠাৎ থেকে ভাবে সে “সব কটা না, কয়েকটা। আর বাকি গুলো কোয়েলি দিদিকে। আমার মার দেওয়া দুগ্গার মূর্তিটা দেবো জ্যাঠা শশুর মশায়কে আর... এই স্লেট পেন্সিল আপনার।” হঠাৎ কেমন চিন্তা হয় তার। “আর তো কিছু নেই আমার, তবে মা, শ্বশুরমশাই আর বটুককে কি দেবো?” ভারী চিন্তা তার মনে।
“বটুককে আমার শিশিতে জমানো মোয়া আর নাড়ুগুলো দিয়ে যাবো, মরে গেলে কি আর খাব নাকি সেগুলো?” হাসে সে। হঠাৎ কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে অনিরুদ্ধ। গম্ভীর হয়ে বলে “অনেক বেশি কথা বলছ, পড়তে হলে পড় নাহলে ঘুমাও।” তার বকুনিতে থেমে যায় বন্দিতা। খানিকক্ষণ আবার মন দেয় লেখার দিকে তারপর বলে, “আপনি আমার স্লেট পেন্সিলে অন্য কাউকে পড়াবেন না তো?” ভ্রূকুটি করে তাকায় অনিরুদ্ধ তার দিকে।
“মানে?”
“আমার স্লেট পেন্সিলে আর কোনদিন কাউকে পড়াবেন না, কথা দিন।” হঠাৎ নিজের বুকে চেপে ধরে সে স্লেটটাকে। অনিরুদ্ধ অবাক। “কি বলছো তুমি এসব?” ধমক দেয় সে।
“ওই দিদিদের পাড়ার ঘোষ বাড়িতে অমন হয়েছে।” হঠাৎ কেমন রাগ প্রকাশ পায় তার কন্ঠে।
“কি হয়েছে?” প্রশ্ন করে অনিরুদ্ধ।
“এবার শীতে ওদের বাড়ির বউ ওলাওঠায় মরলে, আবার বিয়ে হয়েছে ছেলেটার, তার সব কাপড় গয়না সব দিয়ে দিয়েছে নতুন বউকে, আমি দেখলুম যে সেদিন পুকুরপারে গিয়ে।” হঠাৎ জিভ কাটে সে। তার যে পুকুরপারে যাওয়া নিষেধ করেছেন উনি।
“ওহ তাই বুঝি?” কেন জানি সেদিকে লক্ষ্য নেই অনিরুদ্ধর। তারও মুখে ভ্রূকুটি।
“তাই আমি উইল করব ব্যারিস্টার বাবু।” গম্ভীর হয়ে বলে বন্দিতা। “আমার জিনিস কাউকে দিতে পারবেন না আপনি।” তার সহজে বলা কথাটির যে কি ভীষণ তাৎপর্য তা বন্দিতার শিশুসুলভ মন বোঝেনা। প্রথম বার স্ত্রীর মতন কথা বলেছে সে, নিজের অজান্তেই। তার ছোট হাত হঠাৎ নিজের হাতে নিয়ে মৃদু হাসে অনিরুদ্ধ, “তোমার কিছুই অন্য কেউ কোনদিন পাবেনা বন্দিতা।”
“কথা দিন।”
“কথা দিলাম। যা তোমার, তা তোমারই থাকবে।”
অনিরুদ্ধ যখন বাড়ি ফেরে, তখন ভোরবেলা। ইতস্তত করে ঘরে ঢুকে সে দেখে, বন্দিতা ঘুমাচ্ছে, তার জায়গায়। সে এটা আগেও লক্ষ্য করেছে, সে না থাকলেও তার দিকটা ফাঁকা রেখে শয়ে বন্দিতা। যেন সে যে কোনো মুহূর্তে আসবে। স্নান করতে চলে যায় অনিরুদ্ধ। মনে মনে ভাবে, দোর দিয়ে সারাদিন পড়ার ঘরে কাটিয়ে দেবে সে। বন্দিতার মুখদর্শন করতে চায়না সে। তাকে কুকথা বলার ইচ্ছা নেই অনিরুদ্ধর। বলেও বা কি হবে, নিজের ভুল কি বুঝবে সে?
বন্দিতা দেখে বিহারে চা আনতে বলেছেন ব্যারিস্টার বাবু।
“আমি নিয়ে যাচ্ছি।” উঠে পড়ে সে হাত মুছে কাজ থেকে। নিয়ে নেয় চায়ের পেয়ালা। আচঁল টেনে গিয়ে দাঁড়ায়ে পড়ার ঘরের সামনে। টোকা মারে দরজায়।
“বিহারী তোমায় অনেকদিন বলেছি... “ চোখ তুলে থেমে যায় অনিরুদ্ধ। বন্দিতা চায়ের পেয়ালা তুলে ধরে তার সম্মুখে, হাত থেকে নিয়ে নেয় সে।
“আমার জন্য বাড়ি ফিরবেন না আপনি?” কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে সে। অনিরুদ্ধর চোখ চায়ের দিকে, কিন্তু তাতেও প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় সে বন্দিতার। তার মুখ ম্লান, কণ্ঠস্বর ভারী।
“জানি আপনি প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেননা। তা বলে এত অবিশ্বাস করবেন আমায়? চেনেন না আপনি বন্দিতাকে?” অনিরুদ্ধ চুপ। ঘরে বুঝি তার নিশ্বাসের আওয়াজও তীব্র ভাবে শোনা যাচ্ছে। “বন্দিতা এনেছিল বুটি, এটা সত্যি কথা। কিন্তু সে খায়নি।” তার চোখে জল, অনিরুদ্ধ তাকায় তার মুখের দিকে, চোখ সরিয়ে নেই সে স্বামীর থেকে। “আপনি বন্দিতাকে শিক্ষার আলো দিয়েছেন। তবে সেই শিক্ষায় বিশ্বাস নেই আপনার?”
“না নেই, তুমি যা যা কথা আমার থেকে গোপন করেছো তারপর…” উঠে দাঁড়িয়ে পরে অনিরুদ্ধ।
“কি করতাম আমি? সব ছোট ছোট কথা আপনাকে বললে আমি জানিনা আপনি কি করতে পারেন?” হঠাৎ তার কথায় আরও রেগে যায় অনিরুদ্ধ।
“তার মানে?” প্রথমবার তার বিপ্লবী চিন্তাধারায় যেন সমস্যা হচ্ছে বন্দিতার। “ তুমি চাও এদের কুসংস্কারে অংশীদার হতে? আমি এটা তোমার থেকে আসা করিনি।”
“না চাইনা, কিন্তু আপনি বলেন বুদ্ধিমান সে যে বোঝে কখন প্রতিবাদ করা উচিত। বন্দিতাকে সেই শিক্ষা দেননি আপনি?”
“দিয়েছিলাম। কিন্তু ভেবেছিলাম সে লোকের কথায় হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলবেনা। এখানে এসে সাফাই গাইলে তুমি ঠিক হয়ে যাও না, বন্দিতা। তুমি চুপ করে অন্যায় দেখেছ। এটা আমি তোমার থেকে আশা করিনি। এখন ক্ষমা চাইলে সব... ” মাথা নাড়ে অনিরুদ্ধ, ঘুরিয়ে নেই মুখ বন্দিতার থেকে। বন্দিতা চোখ মোছে।
“আমি এখানে ক্ষমা চাইতে আসিনি, আপনার মনের কিছু ভুল ভ্রান্তি দূর করতে এসেছি মাত্র। আমি শুধু এটুকু বুঝি ব্যারিস্টার বাবু, যে সমাজে বেঁচে থাকতে হলে, তাকে বদলাতে হলে, কিছু জিনিস মানতে হয়, সমাজের বাইরে গিয়ে তা বদলানো যায়না।” প্রশ্বাস ফেলে আবার বলে সে, “আমি বলিনি আপনাকে দিদির বাড়ির কথা কারণ তারপর আর যেতেই দিতেন না আপনি সেখানে। আমি মাসিমার মন রাখতে নিয়ে এসেছিলাম বুটি, ভেবেছিলাম কি হবে ওনাকে কষ্ট দিয়ে? আমি জানি ওতে কিছু হয়না, বন্দিতা এতটা অবুঝ আপনি ভাবলেন কি করে? কিন্তু সে কথা বললে লীলা দিদি যে আর বাঁচত না।” হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে সে। অনিরুদ্ধ একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখে তাকে। “আপনি যাদের উদ্ধার করতে চান, তাদের মধ্যে থেকে বাঁচাটা অনেকটা আলাদা ব্যারিস্টার বাবু, আপনি সেটা না জানলেও বন্দিতা জানে।” তাকিয়ে দেখে সে, অনিরুদ্ধ তখনো মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“আপনার কোনো কথা আজ অবধি অমান্য করেনি বন্দিতা, আর ভবিষ্যতেও করবে না। সে কথা দিচ্ছে। কিন্তু আপনার বিশ্বাস পেতে তাকে কি করতে হবে সেটা তার জানা নেই। আপনি যদি তাকে ভুল বোঝেন, কোথায় যাবে সে?” অনিরুদ্ধ ফিরে তাকায় বন্দিতার দিকে, বন্দিতা ঘুরে বেরিয়ে যেতে যায় ঘর থেকে, কিন্তু থেমে যায় চৌকাঠে।
“বন্দিতা যে আজকে বেঁচে আছে সে জীবন তো আপনারই দান। আজীবন যার কাছে সে কৃতজ্ঞ থাকবে তার কোনো কথা অমান্য করবে, তাকে অসম্মান করবে, কিংবা তার শিক্ষা ভুলে কুসংস্কারের জালে স্বপ্ন বুনবে, সে তেমন মেয়ে নয়। যা তার নয়, তার স্বপ্ন সে দেখেনা ব্যারিস্টার বাবু। তার জন্য বাড়ির বাইরে থাকতে হবেনা আপনাকে। আপনি চাইলে সে চলে যাবে যেখানে আপনি চান। বলে দেখবেন একবার শুধু।” অনিরুদ্ধের সমস্ত শরীরে যেন শিহরন বয়ে যায় বন্দিতার শেষ কথায়। তাঁকে চলে যেতে দেখে আটকাতে চায় সে, কিন্তু শব্দ বেরয়েনা তার কণ্ঠ দিয়ে। ভয় হয়।
কি জানে সে? কি করে জানে? কতটা জানে? এইটাই তো ভয় ছিল তার চিরকাল, যে কৃতজ্ঞতা বোধ জন্মাবে বন্দিতার মনে, আর হয়তো কোনদিন তার উপর যে অধিকার দিয়ে সে কথা বলতো, বায়না করত, কিংবা অভিমান দেখতো, কিছুই করবেনা সে। কি করে বোঝাবে অনিরুদ্ধ তাকে যে দয়া করে নয়, ভালবেসে তার সাথে সংসারের স্বপ্ন দেখেছে সে?
Comments
Post a Comment