প্রতিশ্রুতি
বন্দিতা মা কে জড়িয়ে ধরে যেন প্রাণ ফিরে পায়।“ভাল আছিস?” জিগেস করে সুমতি। বন্দিতা হঠাৎ খেয়াল করে আগের মতো তার মুখ দেখেই তার মা আর তার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন না। তার সাথে হঠাৎ মনে পরে কত অনায়াসে অনিরুদ্ধ বোঝে যে তার মন খারাপ। একবার জিজ্ঞেস করেছিল সে স্বামীকে, কি করে তিনি বোঝেন তার মন খারাপ। ছোট বন্দিতাকে তার মতন করে বুঝিয়েছিলেন তার স্বামী। আজ বন্দিতা বড় হয়েছে কিন্তু সেই প্রশ্ন সে আর করতে পারেনা। বন্দিতাকে খাটিয়ার উপর বসিয়ে এর মধ্যেই সুমতি যায় তার জন্য মুড়ি মুড়কি আনতে। বন্দিতার চোখ পরে পায়ের নূপুরের উপর। তিনি বলেছিলেন “তুমি খুশি হলে তোমার নূপুরের আওয়াজ অন্যরকম হয়, আর তোমার মন খারাপ হলে অন্যরকম।” বন্দিতা নূপুরটা বাজিয়ে দেখেছিল সেদিন। আজকে সে জানে পার্থক্য তার নূপুরের শব্দে নয়, অনিরুদ্ধের পর্যবেক্ষণ শক্তিতে। আবার কেন তার কথা ভাবছে সে? বাড়ি এসেছে মায়ের কাছে। আর ভাববে না সে, হয়তো দু তিন দিন পর ত্রিলোচনবাবু পাঠাবেন বিহারী কে বন্দিতাকে বাড়ি নিয়ে যেতে, ততদিন মায়ের কাছে একটু শান্তিতে থাকুক না সে।
দুপুরে আম দুধ দিয়ে ভাত দেয় তাকে সুমতি। “তোর প্রিয় খাবার দেখ, মামা আম পেরে দিয়েছে।” বন্দিতা মৃদু হেসে খেতে বসে, বলেনা মা কে যে আট বছরের বন্দিতার প্রিয় ছিল আম দুধ ঠিকই কিন্তু সতেরো বছরের বন্দিতা এখন রসগোল্লা, পায়েস পিঠে বেশি পছন্দ করে। মায়ের চোখে সে যেন সেই দশ বছর আগের মেয়েটা। “সবাই ভাল আছেন?” প্রশ্ন করতে থাকে মা। তারপর তার প্রশ্ন শেষ হলে, মামী আসে, সম্পূর্ণার কথা জিজ্ঞেস করে, তার সদ্যজাত সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করে। “কি ভাগ্যি ছেলে হল, নাহলে নির্ঘাত এবার দিয়ে যেত ওরা।” নিজের মনে বলে মামী।
“বলি তোমার কি পড়ার পালা শেষ হল, নাকি আরও বাকি আছে?” পাশের বাড়ির কাকিমা এসে হেসে দাড়ান সামনে। “তাতে তোমার কি? নামটাও তো লিখতে পারনা।” বলে তার মেয়ে। “তুই থাম।” বকে তার মা। মামী সায় দেয় “দিদি আমাদের তো এই বয়েসে দুটি করে হয়ে গেছিল, এরা আবার বেশি শিক্ষিত জমিদার কিনা, চাল চলন অন্য রকম।” বন্দিতা উঠে যায়, শোনে তাদের ভাসা ভাসা কথা, “স্বামীর সোহাগ আছে ঢের, নিতে এলেন বলে।” হাসাহাসি করে তারা। বন্দিতা গিয়ে বসে পড়ন্ত দুপুরে পুকুর পারে, দেখে দূরে মাঠে ছেলেমেয়েরা লুকোচুরি খেলছে।
“তাহলে আমি আর ছোট ঠাকুরপো লুকবো, আপনি খুঁজবেন।” অনিরুদ্ধ অনিচ্ছা সত্যেও মাথা নাড়ে। “দু বার কিন্ত, তারপর কাজ আছে আমার।” ছুটে চলে যায় বন্দিতা, সে চোখ বন্ধ করে গুনতে থাকে। বাইরের ঘরে শুনতে পায় বন্দিতা আর বটুকের ফিসফিসানি তারপর তার নূপুরের আওয়াজ। অনায়াসে খুঁজে পেয়ে যায় তাকে। “আপনি কি করে জানলেন আমি কোথায়?” পড়ার ঘরের টেবিলের নিচে থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করে বন্দিতা। “তোমাকে চিনি তাই।” স্বামীর কথা বিশ্বাস হয়না তার, হাটতে গিয়ে খেয়াল হয় নিজের নূপুরের শব্দ। “আপনি চুরি করেছেন, আমার নূপুরের আওয়াজ শুনে।” খুলে ফেলে সে নূপুর দুটি। “ঠিক আছে এবার লুকাও দেখি, ঠিক খুঁজে পাবো আমি।”
“যেখানেই লুকাই?” যেন যুদ্ধার্থে আওভান জানায় বন্দিতা অনিরুদ্ধকে, জিততে তাকে হবেই।
“পৃথিবীর যেখানেই লুকাও।” নিচু হয়ে তার সামনে দাড়িয়ে বলে অনিরুদ্ধ। “আমি ঠিক তোমায় খুঁজে বেড় করব।”
পুকুরপারে কেউ যদি তাকে দেখে, তাই চোখের জল মুছে ফেলে বন্দিতা। মনে মনে ভাবে, আজ তো আমি লুকিয়ে নেই ব্যারিসট্রা বাবু, তবে কেন আমায় খুঁজতে চান না আপনি?
দু’দিন পর অনিরুদ্ধ আসেনা। বন্দিতা যেন জানত সে আসবে না। তাকে ক্ষমা করেনি এখনো মাসীমার বাড়ির বুটির জন্য। কিন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে আসে তার নামে একটি চিঠি। মামা খামটা এনে দেয় তার হাতে। বন্দিতা চেনে খমের উপর তার নামটা ব্যারিস্টার বাবুর হাতের লেখা। সে চলে যায় ঘরে। ভয় হয়, তিনি কি তাকে ত্যাগ করলেন? জানিয়ে দিলেন যে আর বাড়ি ফিরতে হবেনা তাকে? কি বলবে সে মা কে? কোথায় যাবে? কাঁপা হাতে চিঠি খুলে পড়তে বসে সে।
“ আজ কলকাতাতে একটা মামলা এসেছে বলে যেতে হচ্ছে। একজন আসামিকে ছাড়াতে হবে। আমি জানি আমি বলেছিলাম আজ আসব তোমায় নিতে, তাই লিখে জানাচ্ছি যে কলকাতায় কাজ শেষ হলেই যাব আমি দেবীপুর। বিহারীকে ডাকতে হবেনা তোমার।
সেদিন বৃষ্টিতে সারা ঘর এলোমেলো হয়ে গেল। তুমি না থাকলে এরকম হয়, খেয়াল থাকেনা আমার জিনিস পত্রের। সেগুলো গোছাতে বসলাম তুমি এলে রাগ করবে ভেবে। তোমার পুরোনো ট্রাঙ্কটা খুলে তোমার পুতুল, পেন্সিল, রং সব দেখছিলাম। কত খাতা ভরে লিখেছো। খাতার মধ্যে তোমার চিঠি পেলাম।” হঠাৎ হৃদপিন্ড কাঁপে বন্দিতার। সে জানে অনিরুদ্ধ কোন চিঠির কথা বলছে।
“লিখেছো যখন দাওনি কেন চিঠিটা? প্রশ্ন যখন মনে তার উত্তর চাওনি কেন? অবশ্য তোমায় আমি কি করে ভৃত হওয়ার অপবাদ দিই? আমিও যে কোনদিন তোমায় প্রশ্ন করিনি। আজ তবে তোমার প্রশ্নের উত্তর লিখছি। কারণ হয়তো এ কথা তোমার সম্মুখে বলার সাহস আমার হবেনা।
আমি তোমায় উদ্ধার করার কে, বন্দিতা? তোমার মত সাহসী, বুদ্ধিমতি মেয়ে কটা আছে বঙ্গদেশে? আমি বিলেত থেকে ফিরেছিলাম এই ভেবে যে দেশ উদ্ধার করব। ইংরেজদের গুলামী করব না। কিন্তু তুমি আমায় বুঝিয়েছিলে আমারও যে উদ্ধারের দরকার ছিল। আমার অগোছালো জীবন, দিশাহীন বিপ্লবে পথ দেখিয়েছ তুমি। তোমায় যেদিন প্রথম দেখি, অসহায় নিষ্পাপ শিশুর রূপে, বিশ্বাস করো, তার পর থেকে কোনদিন সেই মেয়েটার সাথে তোমার কোন মিল পাইনি। আমায় মুক্তির পথ দেখিয়েছ তুমি, আমার জীবনের উদ্দেশ্য তোমার স্বপ্নপূরণ। তোমায় ছাড়া কি গতি আছে আমারও? আমার সব স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ ও বিপ্লবের চিত্র তোমায় ঘিরে। আমার বোঝা উচিত ছিল যে তুমি আর পাঁচটা স্ত্রীর থেকে আলাদা। বলা উচিত ছিল সেই সব সত্যি যা তুমি অন্যভাবে জেনেছ। ভয় আমারও হত যে সত্য জেনে যদি আমায় স্বামী রূপে গ্রহণ না করো তুমি আমার কি হবে? আজ আমি তোমায় কবিদের মতো বড় বড় শব্দে নিজের মনের কথা বলতে পারিনা ঠিকই; পারিনা তোমার জন্য প্রবন্ধ উপন্যাস লিখতে। কিন্তু কেউ যদি আজ আমায় বলে সেদিন তোমার প্রাণ বাঁচানোর অন্য উপায় করতে, আমি স্বগর্বে বলব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত আমি সেদিন নিয়েছিলাম। তা নিয়ে আমার কোনদিন অনুতাপ হয়নি। এবং যে কোন দিন, যে কোন পরিস্থিতিতে, এই জন্মে এবং পরের সমস্ত জন্মে আমায় বিকল্প দিলেও আমি তোমার সঙ্গ বেছে নেব নির্দ্বিধায়। আমাদের জীবন সহজ নয়, তোমার আমার স্বপ্ন আমাদের সংসারের থেকে অনেক বড়, তোমায় ব্যারিস্টার হতে হবে, মেয়েদের উদ্ধার করতে হবে, স্বাধীন ভারতে স্বাধীন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে হবে তাদের। সেই বিরাট স্বপ্নে তোমার পাশে থেকে, তোমার সাথে হেঁটে সামান্য অংশীদার হতে চাই আমি। সমস্ত কঠিন পরীক্ষায় তোমার হাত ধরে জয়ী হতে চাই আমি। এইটুকু চাহিদা আমার আমাদের সম্পর্ক থেকে। আমি জানি সবার অনেক রকম জল্পনা আমাদের নিয়ে, কিন্তু বন্দিতা, তারা তো আমাদের সংসার করেনা, তারা আমাদের জীবন বাঁচে না। তারা কি করে জানবে আমাদের সুখের সংজ্ঞা? বলো, সবার কথা ঠিক আগের মতই অগ্রাহ্য় করে, আমার হাত ধরে পারবেনা জীবনে সুখী হতে?”
হঠাৎ গাড়ির শব্দে বন্দিতার হাত থেকে পরে যায় চিঠিটা। তার চোখ ঝাপসা, যেন অনেকদিনের জমে থাকা কান্নার বাঁধ ফেটে পরতে চায়। বন্দিতা মেঝেতে বসে পরে। বাইরে এসে ছোট মামাতো বোন জানিয়ে যায় জামাইবাবু এসছেন তাকে নিয়ে যেতে। অনেক কাজ তার দাড়ানোর সময় নেই, বন্দিতা যেন তৈরি হয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসে। ভাঙ্গা গলায় সারা দিয়ে বন্দিতা জানায় সে তৈরি হচ্ছে। লাল শাড়ীটা বের করে নেয় সে পুটলি থেকে। ভাবতে থাকে বন্দিতা কি করে তাকাবে সে স্বামীর দিকে, কি বলবে সে? চিঠিটা স্বযত্নে তুলে নেয় কাপড়ের ভাঁজে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে বোনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় উঠোনে। অনিরুদ্ধকে আম খেতে বলছিল মামা, সে মাথা নেড়ে মানা করছিল। হঠাৎ বন্দিতার দিকে দৃষ্টি যায় তার। এই লাল শাড়ীটা তাদের অষ্টমঙ্গলাতে পড়েছিল বন্দিতা। তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয় লজ্জিত বন্দিতা। যেন নতুন বউ সে।
“আমরা তবে আসি।” মা কে প্রণাম করে উঠে পরে অনিরুদ্ধ। “আপনি এবার আসুন দেখি তুলশিপুর নাহলে কিন্তু আমি পরের বার আর জামাই ষষ্টিতে আসবনা।” বলে গাড়িতে গিয়ে ওঠে সে। মাকে জড়িয়ে ধরে বন্দিতা। হঠাৎ কান্না পায় তার। যেন প্রথম বিয়ের পর বাড়ি যাচ্ছে সে। গাড়িতে গিয়ে ওঠে অনিরুদ্ধর পাশে।
কোন কথা হয়না তাদের পরস্পরের সঙ্গে, যেন শব্দ ব্যয়ের প্রয়োজন মিটে গেছে তাদের মধ্যে, এই নীরবতা তাদের ঘনিষ্টতার সাক্ষী। আজ প্রকৃতপক্ষে নতুন জীবনের, স্বপ্নের, অঙ্গীকারের প্রতিশ্রুতি অনিরুদ্ধ ও বন্দিতার সম্মুখে।গাড়ি চলতে থাকে তুলশিপুরের দিকে।
Comments
Post a Comment