ঘরে ফেরা
জমিদার ত্রিলোচন রায় চৌধুরীর যাকে পছন্দ নয় তাকে তিনি সেটা বুঝিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেন না। বন্দিতার মামা তার তেমন এক অপছন্দের পাত্র । বৌমার মুখে তিনি যা শুনেছেন তারপর বৌমার তাদের প্রতি টান দেখে আশ্চর্য হন ত্রিলোচন বাবু। কিন্তু কুটুম্ব তারা। হাতে করে মিষ্টি এনে দাড়ালে কি বা করা যায়? অতিথিকে অসম্মান করা তো জমিদারের সাজে না। বন্দিতা মামাকে প্রণাম করেই জিজ্ঞেস করে মায়ের কথা। তিনি কেমন আছেন, তার বন্দিতার জন্য চিন্তা হয় কিনা, তাকে কি কি বলতে হবে সব। বৌমার মায়ের সাথে দেখা হয়না অনেকদিন তা ত্রিলোচনবাবু জানেন।
“তো বৌমা, যাও না মামার সাথে, কিছুদিন থেকে এস মায়ের কাছে।” ত্রিলোচনের কথায় যেন চোখ ছলছল করে ওঠে বন্দিতার।
“সত্যি যাব?” জিজ্ঞেস করে বন্দিতা। মাথা নাড়েন ত্রিলোচন। “ওনার যদি আপত্তি… “
“ না না ছিঃ ছিঃ আমার আবার কিসের... “ অল্প হেসে বলে তার মামা, “ও যদি আসতে চায়... “
“তুমি দাড়াও মামা, আমি এক্ষুনি আসছি।” দৌড়ে ভেতরে যায় বন্দিতা। পুটলি বাঁধতে গিয়ে হাত থেমে যায় একবার। ব্যারিস্টার বাবুকে বলবে সে? জিজ্ঞেস করবে যাবে কিনা? হঠাৎ অভিমান হয় তার। তিনি তো চান না সে থাকুক, বিশ্বাস করেন না তাকে, আর জ্যাঠাশশুরমশাই তো যেতেই বলেছেন। কেন শুধাবে আবার তাকে? চলে যাবে মায়ের কাছে থাকতে। বেশ হবে তার। তিনি জিনিস পত্র খুঁজে পাবেন না, বেশ হবে। তার মুখদর্শন করতে হবেনা, তার উপর রেগে বাড়ির বাইরে রাত কাটাবেন না, নিজের বিছানায় শোবেন। ভালই হবে তার।
এমনটাই ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক বন্দিতা দেখেই না কখন অনিরুদ্ধ তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে তাকে পুটলি বাঁধতে দেখছে সে, তার মুখে ভ্রূকুটি, মনে ভয়। সেদিনের পর কাজের কথা ছাড়া আর কথাই বলেনি তারা। অনেকবার চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনা সে কি বলবে বন্দিতাকে।
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছ এসব জিনিস?” তার কথায় চমকে ওঠে বন্দিতা। হাত থেকে পরে যায় চিরুনি। পেছনে ফিরে দেখে অনিরুদ্ধ মেঝে থেকে চিরুনি তুলছে, তার মুখে অসন্তুষ্টির ভাব।
“আপনি? উঠে পড়েছেন?” হঠাৎ প্রশ্ন করে বন্দিতা, “এত সকালে?”
“বিহারী বললো মামা... এসব কি?”
“আমি মামার সাথে বাড়ি যাব।”
“তার মানে?” অনিচ্ছা সত্তেও কেমন চেঁচিয়ে ওঠে অনিরুদ্ধ, পেছনে সরে যায় বন্দিতা।
“মানে, জ্যাঠাশশুরমশাই বললেন আমি মায়ের কাছে... “
“কোথাও যাবে না তুমি।” হঠাৎ তার পুটলি থেকে জিনিস বের করতে থাকে অনিরুদ্ধ। “মামার সাথে যাবার দরকার নেই, আমি গিয়ে দেখা করিয়ে আনবো বলেছি তো।” তার ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বরে রেগে যায় বন্দিতা। ভুলে যায় তার প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে বাঁচার প্রতিজ্ঞা। এত বছরের অভ্যেস তার ব্যারিস্টার বাবুর সাথে তর্ক করার।
“কেন যাবনা আমি, শুনি?” অনিরুদ্ধ থেমে তাকায় তার দিকে, হঠাৎ বন্দিতার অধিকারের সুরে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে, “আমার মামার সাথে আমি কেন যাবনা মায়ের কাছে?” তার হাত থেকে পুটলিটা কেড়ে নিতে সক্ষম হয়না বন্দিতা।
“বললাম তো আমি নিয়ে যাব।” নিজের মাথার উপর পুটলিটা তুলে বলে অনিরুদ্ধ।
“হ্যাঁ আপনি তো আজও নিয়ে যাচ্ছেন কালও নিয়ে যাচ্ছেন।” মুখ গোমরা করে বন্দিতা, “ দিন আমার জিনিস ফেরত। জ্যাঠা শশুরমশাই বলেছেন আমায় যেতে।”
“বলুক, আমি বলছি তো যাবেনা।”
“আরে, আমার মায়ের সাথে দেখা করতে বাঁধা দিচ্ছেন আপনি?”
“না। তুমি ভালো করেই জানো কেন বাঁধা দিচ্ছি।”
“না আমি জানিনা।” প্রতিবাদ আরও তীব্র ভাবে ফুটে ওঠে বন্দিতার সুরে। “আপনার মতিভ্রম হয়েছে।”
“কি?” কেমন আঁতকে ওঠে অনিরুদ্ধ, তার নিজের বলা কথায় ভয় পায় বন্দিতা, এ কি অলুক্ষুণে কথা বললো সে?
“তুমি নিজের জেদের জন্য আমায় পাগল বলছ?” অনিরুদ্ধের কণ্ঠ তিক্ত। “বন্দিতা তুমি ভালো করে জানো তুমি কেন জেদ করছ, আমি সেই জেদ মানছি না।”
“কি হচ্ছেটা কি?” চৌকাঠের বাইরে ত্রিলোচনবাবুকে দেখে ঝগড়ার মাঝে পরে যাওয়া ঘোমটা টেনে নেয় বন্দিতা। অনিরুদ্ধের হাত থেকে নেমে আসে পুটলি, দুজনের মুখে অপ্রস্তুতির আভাস। গলা খাকরণ ত্রিলোচন রায় চৌধুরী। তার ছেলে বৌমার মাথায় যে মাঝে মাঝে ভূত চাপে তা তার জানা , তা বলে বাড়িতে অতিথি, তার মধ্যে কিসের মনোমালিন্য়?
“দেখুন না আমায় যেতে দিচ্ছেন না উনি মায়ের কাছে।” নালিশ করে বন্দিতা।
“না...মানে “ হঠাৎ জ্যাঠার সামনে অপ্রস্তুত অনিরুদ্ধ। “আমি বলছি মামাকে কেন বিব্রত করা, আমি নিয়ে যাব।”
“কবে?” বন্দিতার প্রশ্ন। “গত এক বছরে কত বার বলেছেন এরকম? নিয়ে গেছেন একবারও?”
“বৌমা ঠিকই তো বলছে, যাক না মামার সাথে। মামাই তো, তুমি গিয়ে নিয়ে এসো পরে, ক্ষতি কি?”
“নাহলে আমার যাওয়াই হবেনা।” সায় দেয় বন্দিতা। “উনি এত ব্যস্ত উনি আনতে পারবেননা আমায়, আপনি বিহরিকে পাঠিয়ে দেবেন।”
“পারবো। আমি আনতে পারব।” জোর গলায় বলে অনিরুদ্ধ, বন্দিতা মুখ তুলে তাকায় তার দিকে।
“তাহলে আর কি? পরশু চলে যেও আনতে। বৌমা তাড়াতাড়ি এস, তোমার মামা বলছেন গাড়ি চলে যাবে।” ত্রিলোচন বাবু এখনো বোঝেন না ছেলের এমন প্রতিবাদ কেন। কিন্তু তার সব কথা বোঝার আর চেষ্টাও করেন না তিনি। কি লাভ? “ আর অনিরুদ্ধ, তুমি বরং বৌমাকে উকিল বানাও।” ঠাট্টা করে বলেন তিনি, “তর্কটা তোমার থেকে বেশি পারে ও।”
অনিরুদ্ধর বোঝার আগেই তার হাত থেকে পুটলি ছিনিয়ে নেয় বন্দিতা, ভরে নেয় বাকি জিনিস। খানিকক্ষণ হাত ভাজ করে দাড়িয়ে তাকে দেখে অনিরুদ্ধ। তারপর শাড়ি বের করে সে পরে যাবে বলে, চাবিটা আঁচল থেকে খুলে বলে “এই দেরাজে রাখলাম এটা, আপনার দরকার হবে।” শাড়ি পড়তে চলে যায় সে, স্নানঘরে। এসে দেখে অনিরুদ্ধ একটা রুমালে কিছু খুচরো টাকা বেঁধে দিয়েছে, “তোমার কাজে লাগতে পারে।” বন্দিতার হাতে দিয়ে বলে সে, চোখ তুলে তাকায় বউয়ের দিকে, তার মুখ যেন ফ্যাকাশে।
“বিশ্বাস করো, পরশু যাব আমি নিজে। ফেরত নিয়ে আসব তোমায়।” বন্দিতা তার কথায় চোখ তুলে চায় স্বামীর দিকে। “তুমি যা ভাবছ সব সত্যি নয়। আমি... ” হঠাৎ যেন বন্দিতার ভয় হয় অনিরুদ্ধ কি কথা বলতে চায় সেই বিষয়।
“দেরি হয়ে যাচ্ছে, আসছি।” হঠাৎ তার কথার মাঝে প্রণাম করে বেরিয়ে যায় বন্দিতা ঘর থেকে। অনিরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। “দুগ্গা দুগ্গা।” আপন মনে বলে ওঠে সে।
Comments
Post a Comment