উত্তর
সারাদিন কাজে মন বসেনা অনিরুদ্ধর। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হতে থাকে, ঝোড়োও হওয়ায় ঘরের পর্দা দোলে , জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে যায়। কয়েলি আসে ছোট মালিকের জিনিস গুছিয়ে দিতে, তিনি কিছু খাবেন কিনা শুধোতে কিন্তু তাকে চলে যেতে বলে ঘরে খিল দেয় অনিরুদ্ধ। একা থাকতে চায়। তার মনে আনাগোনা করে অসংখ প্রশ্ন এবং আশংকা। যে ভাবে বন্দিতা স্বেচ্ছায় মায়ের কাছে গেল আজ, সেরকম সে কোনদিন যায়না । বরং বছরে একবার জামাই ষষ্টিতে যাওয়ার আগেও একশো বার বাড়ির কাজকম্ম দেখে শুনে যায়। বটুকের পরীক্ষা, কারুর শরীর খারাপ হলে তো কথাই নেই। সেই বন্দিতা আজ হঠাৎ বাড়ি যাবে বলে কি তাড়াতাড়ি পোটলা গুছিয়েছে। এতই কি দূরে চলে গেছে সে অনিরুদ্ধের থেকে? তা কি তার নিজের দোষে? ভাবতে থাকে অনিরুদ্ধ। সে দূরে সরিয়ে দিয়েছে বলে অভিমান না কি তাকে স্বামী রূপে গ্রহণ করতে পারেনা বন্দিতা? অনিরুদ্ধ পশ্চাতাপ করে। সত্যি যদি বন্দিতা সব জেনে তাদের সম্পর্ক অস্বীকার করে, তাকে কি দোষ দেওয়া চলে? তবে কি তাই সেদিন রাত্রে জেগে থাকা সত্যেও ঘুমের অভিনয় করছিল সে? কি ভেবেছে সে অনিরুদ্ধের ব্যাপারে? কেন চারিদিক বাছবিচার না করে এমন করল অনিরুদ্ধ? নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে গেল সে? মনে মনে ভাবে যে বিষয়টা সে এতদিন উপেক্ষা করছিল শুধু বন্দিতাকে হারানোর ভয়, সেই বিষয়টা আজ তাকে এতটাই গ্রাস করেছে যে কাজ কর্ম নাওয়া খাওয়া ভুলে আজ তার মন ভবঘুরের মতো দিশা খুঁজছে। বন্দিতার কাছে তাকে যেতেই হবে, কথা বলতে। তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে বাড়িতে। অনিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয় যে বন্দিতা তাকে ত্যাগ করলেও তার প্রতি যে দায়িত্ব অনিরুদ্ধ নিয়েছে, তার পড়াশুনা ভবিষ্যত নিয়ে অনিরুদ্ধর যা স্বপ্ন এবং তার মাকে তার অবিভাবক হওয়ার যে প্রতিজ্ঞা সে করেছে তা থেকে সে কোনদিন বিমুখ হবেনা। একবার স্বাধীন ভাবে জীবন শুরু করার পর যদি বন্দিতা চায়, সে চলে যেতে পারে, অনিরুদ্ধ বাঁধা দেবেনা। তার যদি নতুন করে অন্য কারো সাথে সংসার করতে ইচ্ছা হয় তাতেও সাহায্য করবে। থাকতে পারবে বাকি জীবনটা তার স্মৃতি নিয়ে, নিজের আবেগ তার থেকে গোপন করে। তার বাড়ির লোকে বলে অনিরুদ্ধ বন্দিতার জন্য কি না করতে পারে, তা সত্যি প্রমাণ করবে সে। কিন্ত যতদিন বন্দিতা পড়াশুনা করছে, তার অবিভাবক হিসেবে থেকে যাবে অনিরুদ্ধর অস্তিত্ব। বুকের ভেতর কেমন ভারী হয়ে আসে তার। বসে পরে খাটের উপর, বালিশ চেপে ধরে চেষ্টা করে যাতে বুকের ভার যায়। কিন্তু বালিশে বন্দিতার চিরপরিচিত চাঁপার তেলের গন্ধ। বাইরে মেঘের জন্য মাঝ দুপুরে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। জালনা বন্ধ করে দেয় সে, বৃষ্টি বাড়তে। হওয়ায় উড়ে যাওয়া পাতাগুলো গুছাতে থাকে। মনে মনে ভাবে এরকম অগোছালো ঘর রেখে দেবীপুর গেলে ফিরে এসে রাগ করবে বন্দিতা। সে যদি না ফেরে? মনের সংশয় ভুলতে কাজে ব্যস্ত হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে অনিরুদ্ধ। কটা কাগজ হওয়ায় উড়ে গেছিল খাটের তলায়। উবু হয়ে তা তুলতে গেলে অনিরুদ্ধর চোখ যায় খাটের নিচে রাখা বন্দিতার পুরোনো জিনিসের ট্রাঙ্কে। বের করে আনে সেটা। অসংখ খাতা তাতে, মনে পরে বটুক ও বন্দিতাকে ডায়েরি লিখতে পরামর্শ দিয়েছিল অনিরুদ্ধই। বন্দিতা খালি বলতো মা থাকলে এটা বলতাম ওটা বলতাম তাই একদিন পড়তে বসে বটুকও যখন একই কথা বলেছিল আড়াল থেকে তাদের দেখে কষ্ট পায় অনিরুদ্ধ। বটুকের তো মনেই নেই মাকে। তার স্থান কি কেউ নিতে পারে? সে পড়ার সময় দুজনকে বুঝিয়েছিল মনের কথা, যা কাউকে বলা যায়না তা খাতায় লিখবে। আজ ধুলোয় মাখা খাতাগুলো যেন বন্দিতার মনের চাবিকাঠি। তারিখ দেখে গত দু বছরের খাতা নিয়ে পড়তে থাকে অনিরুদ্ধ মেঝেতে বসেই। আলো জ্বেলে নেয় ঘরে।
নিত্য দিনের কথা আছে খাতায়, কি রান্না শিখল সে, স্কুলের কোন শিক্ষক কেমন, কোন গল্পের বইটা মনে ধরেছে। তারপর আছে বটুক সোমনাথ, শ্বশুরদের কথা, দিদির কথা, মাকে মনে পরার কথা, এমনকি মাসীমার মন রাখতে বড়ি আনার কথাও। পরী দিদির স্কুলে সাহায্য করার কথা, গ্রামের উৎসবের কথা। প্রায় আধখানা পড়ে বন্ধ করে দেয় অনিরুদ্ধ। একটি পাতাতেও তার বিষয় কিছুই লেখেনি বন্দিতা। যেন তার কোন অস্তিত্বই নেই বন্দিতার জীবনে। এমনকি কুকথাও না, সে বদমেজাজি, জেদি, এমনকি সে জ্বরে ভুগছে সেটাও না। তবে কি এইটাই অনিরুদ্ধের উত্তর? চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। সে কি কোনদিন বলতে পারবেনা স্ত্রীকে সে ঠিক কতটা স্নেহ করেছে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাতা তুলে রাখতে থাকে অনিরুদ্ধ। আর পড়ে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ? হঠাৎ খাতার ভেতর থেকে একটা পাতা বেরিয়ে আসে কোলের উপর। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় চিঠি। বন্দিতার হাতের লেখা সে দূর থেকেই চিনতে পারে। কৌতুহল হয়, কাকে চিঠি লিখে পাঠায়নি সে? পড়তে শুরু করে চিঠি।
“হয়তো কোনদিন আপনাকে এই চিঠিটা দিতে পারবনা, হয়তো তার প্রয়োজনও হবেনা। আপনাকে আমি ক্ষুব্ধ করতে চাইনা। কিন্তু মনের এই কথাগুলো যে না বললে নয়। কাকে বলব এসব কথা?” গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে অনিরুদ্ধের। এই উৎসর্গহিন চিঠি কাকে লিখেছে বন্দিতা? “আপনি হয়তো জানেন না, আমার কিন্তু প্রথম দিকের কিছুই খুব একটা মনে নেই। কিন্তু আপনার সাথে প্রথম দিনের একটা কথা মনে আছে।” তবে কি এটি প্রেম পত্র? অনিরুদ্ধের কি না পড়া উচিত? কিন্তু কাকে প্রেমপত্র লিখেছে বন্দিতা? আর তা দেয়নি বা কেন? তার প্রতি অপরাধ বোধে?
“আমার সব কিছুই জানেন, অভ্যাসের মত ছিল। রোজ এক নিয়মে চলা, অন্যের টানা সীমারেখার মধ্যে থাকার স্বভাব বোধ করি সকল মেয়েদের মধ্যে জন্মগত। বাবার কথা, মামার কথা শুনেই অভ্যাস ছিল আমার। মা বলেছিলেন এবার স্বামীর কথা শুনবি , প্রশ্ন করার বদ স্বভাব তোর এবার ত্যাগ কর, বড় হচ্ছিস। তিনি রাগ করবেন। কিন্তু আপনি? আপনি প্রথম দিন আমায় বলেছিলেন, প্রশ্ন করতে ভয় পাবে না। সেদিন থেকে নির্দিধায় প্রশ্ন করে বন্দিতা, আপনারই সাহসে। সমাজের সীমারেখা পেরিয়ে স্বপ্ন দেখে সে আপনার জন্য।”
অনিরুদ্ধের ভেতরে হঠাৎ শিহরণ বয়ে যায়, তাকে চিঠি লিখেছে বন্দিতা? কেন? কি কথা সে বলতে পারেনি? কেন দেয়নি তাকে চিঠিটা?
“কিন্তু বিশ্বাস করুন, মনের মধ্যে এখন অনেক প্রশ্ন আমার, একটাও কেন জিজ্ঞেস করতে পারছিনা আপনাকে? কেন ভয় হয় যে আপনার উত্তরে আমার একটু একটু করে গড়ে তোলা সব স্বপ্ন, এই সংসার সব নিমেষের মধ্যে ধূলিসাৎ হতে পারে। কেন আজ আমি এই ভ্রান্তি নিয়ে সুখী যে আপনি আমার সাথে সুখী?”
অনিরুদ্ধ যেন আবার শ্বাস ফিরে পায় প্রাণে, পাতা উল্টে পড়তে থাকে।
“একটা মস্ত বড় পাপ করেছে বন্দিতা। আপনি জানলে হয়তো ক্ষুব্ধ হবেন। আপনি যেদিন ছিলেন না, ঘর গোছাতে গিয়ে আপনার বাক্স খুলে দেখেছে সে।”
অনিরুদ্ধর ঠোটের কোণে হাসি, যাক বন্দিতা যদি তার চিঠি পড়া নিয়ে রাগ করে, সেও বলতে পারবে কিছু।
“তাতে পরীদিদির চিঠি ছিল। আপনি কেন বলেননি বন্দিতাকে সব সত্যি কথা?” যেন তার কন্ঠস্বরে বেদনা শুনতে পায় অনিরুদ্ধ।
“বন্দিতা এত অবুঝ না, সে চিরজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে, যা তার প্রাপ্য নয় সে কোনদিন কারুর থেকে সেই সুখ ছিনিয়ে সংসার বাঁধবেনা, পরীদিদির থেকে তো নয়ই। তিনি কত স্নেহ করেন বন্দিতাকে। চেনেননা আপনি বন্দিতাকে? তাহলে কেন আপনি সব সত্য লুকিয়ে গেছেন এতদিন? জানেন বন্দিতা সব সময় গর্ব করত যে আপনার সাথে তার গুরু শিষ্য, বন্ধুত্বের সম্পর্ক এত মজবুত কারণ তা সত্যের ভিত্তিতে গড়া। আজ আমি জানলাম সব মিথ্যে। কিন্ত জানেন, এখনো ঠিক বিশ্বাস হয়না। সব কি মিথ্যে? রাতের পর রাত আপনি আমায় জেগে থেকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, শিক্ষার আলো দেখিয়েছেন, সব মিথ্যে? জ্বরে আমার মাথায় হওয়া করেছেন, যখন সবাই তিরস্কার করেছে আপনি আমার পাশে দাড়িয়েছেন। বন্দিতার কাছে সংসারের মানে তো তাই ছিল। অন্য কিছু যে সংসার হতে পারে তা জানতাম কি?
Comments
Post a Comment