ব্যারিস্টার বাবু
English Translation
“এ কি!” আবার? তোমায় কতদিন বারণ করেছি না দেবাদিত্য ?” খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করেই বললেন তুলসীপুরের ছোট জমিদার, ব্যারিস্টার অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী। তার ভ্রূকুটিতে হাত থেমে গেল খাজাঞ্চী পুত্র দেবাদিত্যর । অনিরুদ্ধের বয়েস এখন আঠাশ কি ঊনত্রিশ, জমিদারদের জাঁক জমক তার মধ্যে না থাকলেও তার আভিজাত্য পূর্ণ সুস্বভাব দেখলে বোঝা যায়ে সে উচ্চঘরের বিলেত ফেরত উত্তরাধিকারী। তবে সুবিধাপ্রাপ্ত অন্য বঙ্গসন্তানের মতন সে ব্রিটিশ শাসনকে তোষণ করেনা। সময়ে এলে কোনো কিছুরই প্রতিবাদ করতে তার বাঁধে না।
“আমি...মানে আপনি তো আমায়ে মাইনে দিয়ে কাজে রেখেছেন মালিক, তাই …”
অনিরুদ্ধর চাহনিতে থামতে হল দেবাদিত্যকে। সে এই চাহনি ভালো মতন চেনে । ছোট জমিদার বাবু রেগে গেলে যে সে কি ভীষণ কান্ড ঘটতে পারে তা স্বচক্ষে দেখা তার।
“তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু দেবাদিত্য, তুমি চাকরি করে মাইনে পাও ঠিকই কিন্তু তার মানে এই না যে আমি এলে আমার গাড়ির দরজা খুলে দেবে। তুমি আমার সহকর্মী, আমার বাল্যবন্ধু, তা যে যাই বলুক, আমি তা মানি, তোমায় সম্মান করি, সে কথা তুমি জানোনা?”
“জানি অনিরুদ্ধ বাবু,কিন্তু...” ইতস্তত বোধ করে দেবাদিত্য। আসে পাশে মালী, দারোয়ান , চাকর বাকর ঘুরছে, সবাই তার প্রতিবেশী। হঠাৎ নিজেকে জমিদারবাবুর সমান কি করে ভেবে নেবে সে?
“কোনো কিন্তু না, তুমি তো চেনো নিজের বৌঠান কে, খুব রাগ করবে ফের তার জামাইবাবুকে এরকম দরজা খুলতে দেখলে।” অল্প হেসে নিজের বিলিতি কোট গাউন হাতে নিয়ে বলে অনিরুদ্ধ, “তখন তার রাগ সামলিও।” মৃদু হাসে দেবাদিত্য। অনিরুদ্ধ ক’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে চলে যায়ে জমিদার বাড়ির সদরের দিকে।
“আমি...মানে আপনি তো আমায়ে মাইনে দিয়ে কাজে রেখেছেন মালিক, তাই …”
অনিরুদ্ধর চাহনিতে থামতে হল দেবাদিত্যকে। সে এই চাহনি ভালো মতন চেনে । ছোট জমিদার বাবু রেগে গেলে যে সে কি ভীষণ কান্ড ঘটতে পারে তা স্বচক্ষে দেখা তার।
“তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু দেবাদিত্য, তুমি চাকরি করে মাইনে পাও ঠিকই কিন্তু তার মানে এই না যে আমি এলে আমার গাড়ির দরজা খুলে দেবে। তুমি আমার সহকর্মী, আমার বাল্যবন্ধু, তা যে যাই বলুক, আমি তা মানি, তোমায় সম্মান করি, সে কথা তুমি জানোনা?”
“জানি অনিরুদ্ধ বাবু,কিন্তু...” ইতস্তত বোধ করে দেবাদিত্য। আসে পাশে মালী, দারোয়ান , চাকর বাকর ঘুরছে, সবাই তার প্রতিবেশী। হঠাৎ নিজেকে জমিদারবাবুর সমান কি করে ভেবে নেবে সে?
“কোনো কিন্তু না, তুমি তো চেনো নিজের বৌঠান কে, খুব রাগ করবে ফের তার জামাইবাবুকে এরকম দরজা খুলতে দেখলে।” অল্প হেসে নিজের বিলিতি কোট গাউন হাতে নিয়ে বলে অনিরুদ্ধ, “তখন তার রাগ সামলিও।” মৃদু হাসে দেবাদিত্য। অনিরুদ্ধ ক’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে চলে যায়ে জমিদার বাড়ির সদরের দিকে।
সত্যি বলতে বন্দিতার রাগ, অভিমান, দুঃখ কোনটাই দেখেনি দেবাদিত্য । যেদিন সব থেকে কাছ থেকে তাকে দেখেছে, সেদিন সম্পূর্ণার বর্ণনা করা বন্দিতার সাথে তার কোনো মিল ছিলনা। সে ছিল নিস্তেজ, ঘুমন্ত ছোট্ট একটি বিয়ের কনে যার থেকে প্রায়ে ষাট বছরের প্রৌঢ় কিন্তু ধনী বরটি বিয়ের পিঁড়িতেই হৃদযন্ত্র বিকলে পরলোকে গমন করে । সে নাহয়ে ঈশ্বর মেয়েটির মঙ্গলের কথা ভেবেই সেই কান্ড ঘটান কিন্তু মানুষ যে বড় নিষ্টুর ও বোকা। তারা কি করে ছেড়ে দেয় অমন লগ্নভ্রষ্ঠ মেয়েকে? তাও আবার গরীব।
দেবাদিত্য কল্পনাও করতে পারেনি যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় দিনটা সে এইভাবে মনে রাখবে। তার আর সম্পূর্ণার বিয়ের দিন বরযাত্রীর অতিথি হয়ে আসা সদ্য বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী সেদিন নিজের জীবনে স্বেচ্ছায় কি ঝড় আনতে চলেছিল? সারা দেবীপুর গ্রামের লোকের সামনে দাঁড়িয়ে সে একটি আট বছরের শিশুকে সতীদাহ প্রথার কুরীতি থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল মাত্র। সে তো জানত না তার মূল্য দিতে হবে তাকে। ছায়ার থেকেও বেশি অন্ধকারে যার পাশে থাকার কথা দিয়েছিল সে, যার জীবনে আলো আনতে পিছুপা হবেনা বলেছিল, তার বিলেত ফেরা বিপ্লবী মন জানতনা তার মূল্য হতে চলেছে বন্দিতার সিঁথির সিঁদুর । আর কি কোনও উপায়ে ছিলনা ছোট্ট বন্দিতার নিষ্পাপ জীবন বাঁচানোর? থাকলে কি সেই উপায়ে নিতো না অনিরুদ্ধ ? নিজের ছেলেবেলার সাথী সৌদামিনী কে দেওয়া সব অঙ্গীকার ভুলে সে কি করে পারল এমন সর্বনাশ করতে? দেবাদিত্যর আজও ভাবলে হৃদপিন্ড কাঁপে । সে কেন, অনেকেই পারত না যা অনিরুদ্ধ পেরেছে । শুধু তাতে থামবার ছেলে সে নয়। বন্দিতাকে শিক্ষিত স্বাধীন চিন্তাধারা নিয়ে বড় হতে শিখিয়েছে তার ব্যারিস্ট্রা বাবু। তাকে অক্ষর জ্ঞান থেকে চক্রবৃদ্ধি সুদ সব নিজে হাতে শিখিয়ে বিদ্যালয় পাঠিয়েছে সে। দেবাদিত্য এটা বুঝেছে যে মানুষ তার দেবতুল্য বন্ধুকে ভুল বোঝে। সে পাগল নয়, বিপ্লবী নয়, শুধু একটা রক্ত মাংসের মানুষ, যার মনুষ্যত্ব বোধ তাদের সবার থেকে অনেক বেশি।
অনিরুদ্ধ অভ্যাসবসত ঘরে ঢুকে দেখে নিল তার ইস্তিরি করা পাট ভাঙ্গা পাঞ্জাবি রাখা রয়েছে খাটের এক কোণে, তার বিলিতি তোয়ালে শেভিং সরঞ্জাম ও আতর হাতের সামনে সাজানো। আপন মনে ঘড়িটা খুলে সে সবে টেবিলে রেখেছে এমন সময় কানে এল চিরপরিচিত নূপুরের শব্দ। বাইরের বারান্দা থেকে আরও ঘরের কাছে আসছে। খানিকটা অবাক হল অনিরুদ্ধ। তার তো বাড়ি থাকার কথা নয়। অনেক দিন ধরে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা ছিল যে, তবে কি হল? কৌতূহলের দৃষ্টিতে দরজার চৌকাঠে চোখ পরতে না পরতেই হাজির, মুখে হাসি ও হাতে শরবত নিয়ে বন্দিতা।
“এ কি, যাওনি দিদির কাছে?” প্রশ্ন করলো অনিরুদ্ধ, তার স্বরে কেমন যেন সন্দেহের সুর। বন্দিতা গ্লাস রেখে, কাপড়ের আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল, “বাঃ রে, গেছিলাম বলেই তো এমন সেজেছি, এমনই এমনই এমন সেজে থাকি বুঝি আমি?”
“সে তুমি ইচ্ছে করলেই পারো, জ্যাঠামশাই খুশিই হবেন।” অনিরুদ্ধ তার স্ত্রীর কটাক্ষ দৃষ্টি এড়িয়ে, শরবত এক চুমুকে শেষ করে মুচকি হাসলো।
“মাঝ দুপুরে পরিহাস করছেন আপনি?”
“বাঃ রে,পরিহাসের আবার সময় ধরা বাঁধা আছে বুঝি?” বন্দিতা হাসলো না, উত্তরে অনিরুদ্ধের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বলল, “খাবার কিন্তু তৈরি, শ্বশুরমশাইরা আপনার জন্য না খেয়ে বসে আছেন, তাড়াতাড়ি আসবেন।” সে ঘুরে দরজা দিয়ে বেরতে যাবে হঠাৎ অনিরুদ্ধ তার রাস্তা আটকে খানিক গম্ভীর্যয়ের সাথেই বলল, “ঠিক করে বলো বন্দিতা, কি হয়েছে ওখানে যে তুমি চলে এলে?”
“কি আবার হবে, ব্যারিস্ট্রাবাবু?” মাথা নাড়ে বন্দিতা। “হলে কি আপনি জানতেন না?”
“তাহলে কি তোমার শরীর খারাপ?” নির্দ্বিধায় তার কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে অনিরুদ্ধ। বন্দিতা সরে যায়েনা। হেসে বলে, “হল এই যে আজ আমি জানলাম আপনার থেকে আমার মাথায়ে অনেক বেশি বুদ্ধি। হয়েছে? এবার যাবেন স্নানঘরে না কি আমি গিয়ে জ্যাঠামশাইকে বলব?”
“এবার কে কথা এড়িয়ে পরিহাস করছে শুনি?” উৎকন্ঠিত ভাবে বলল অনিরুদ্ধ। “তোমার আমার থেকে যে ঢের বেশি বুদ্ধি তা আমি জানি।”
“জানেন?” বন্দিতা চোখ কপালে তুলে মুখ টিপে হেসে ফেলল, “তা এতদিন বলেননি কেন?”
“তোমার অহংকার হবে বলে।” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে, “যাও এবার খাবার দাও, খিদে পেয়েছে।”
“ওমা, আমি তো যাচ্ছিলুম, আপনিই তো আটকালেন ।” অবাক হয় বলল বন্দিতা, তারপর স্বামীর মৃদু হাসি দেখে মুখ বেঁকিয়ে চলে যায় সে হেঁসেলের দিকে।
“এ কি, যাওনি দিদির কাছে?” প্রশ্ন করলো অনিরুদ্ধ, তার স্বরে কেমন যেন সন্দেহের সুর। বন্দিতা গ্লাস রেখে, কাপড়ের আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল, “বাঃ রে, গেছিলাম বলেই তো এমন সেজেছি, এমনই এমনই এমন সেজে থাকি বুঝি আমি?”
“সে তুমি ইচ্ছে করলেই পারো, জ্যাঠামশাই খুশিই হবেন।” অনিরুদ্ধ তার স্ত্রীর কটাক্ষ দৃষ্টি এড়িয়ে, শরবত এক চুমুকে শেষ করে মুচকি হাসলো।
“মাঝ দুপুরে পরিহাস করছেন আপনি?”
“বাঃ রে,পরিহাসের আবার সময় ধরা বাঁধা আছে বুঝি?” বন্দিতা হাসলো না, উত্তরে অনিরুদ্ধের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে বলল, “খাবার কিন্তু তৈরি, শ্বশুরমশাইরা আপনার জন্য না খেয়ে বসে আছেন, তাড়াতাড়ি আসবেন।” সে ঘুরে দরজা দিয়ে বেরতে যাবে হঠাৎ অনিরুদ্ধ তার রাস্তা আটকে খানিক গম্ভীর্যয়ের সাথেই বলল, “ঠিক করে বলো বন্দিতা, কি হয়েছে ওখানে যে তুমি চলে এলে?”
“কি আবার হবে, ব্যারিস্ট্রাবাবু?” মাথা নাড়ে বন্দিতা। “হলে কি আপনি জানতেন না?”
“তাহলে কি তোমার শরীর খারাপ?” নির্দ্বিধায় তার কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে অনিরুদ্ধ। বন্দিতা সরে যায়েনা। হেসে বলে, “হল এই যে আজ আমি জানলাম আপনার থেকে আমার মাথায়ে অনেক বেশি বুদ্ধি। হয়েছে? এবার যাবেন স্নানঘরে না কি আমি গিয়ে জ্যাঠামশাইকে বলব?”
“এবার কে কথা এড়িয়ে পরিহাস করছে শুনি?” উৎকন্ঠিত ভাবে বলল অনিরুদ্ধ। “তোমার আমার থেকে যে ঢের বেশি বুদ্ধি তা আমি জানি।”
“জানেন?” বন্দিতা চোখ কপালে তুলে মুখ টিপে হেসে ফেলল, “তা এতদিন বলেননি কেন?”
“তোমার অহংকার হবে বলে।” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে, “যাও এবার খাবার দাও, খিদে পেয়েছে।”
“ওমা, আমি তো যাচ্ছিলুম, আপনিই তো আটকালেন ।” অবাক হয় বলল বন্দিতা, তারপর স্বামীর মৃদু হাসি দেখে মুখ বেঁকিয়ে চলে যায় সে হেঁসেলের দিকে।
অনিরুদ্ধ পকেট থেকে কিছু জরুরী কাগজ পত্র বের করে রাখতে লাগলো এক এক করে টেবিলের উপর। মনের মধ্যে অন্য চিন্তা। কি হলো এমন যা বন্দিতা বলতে নারাজ? হঠাৎ তার চোখ পড়ল একটি ভাজ করা খামে। কাজের মাঝে সৌদামিনীর চিঠিটাই পড়তে ভুলে গেছিলো যে!
Comments
Post a Comment