তুলসীপুরের কথা
সাহেব পুলিশ এসে দাড়াল জমিদারবাবুদের কাছে। সে ভালো করে জানে তার মনের সন্দেহের কোন প্রমাণ নেই, এরা পড়াশুনা জানা ভদ্রসমাজের বাবু। এদের সাথে চালাকি চলবে না। তা ছাড়া লাট সাহেবের সচিবকে চেনে এরা।
“বলুন।” খানিকটা বিরক্ত স্বরে বললেন ত্রিলোচন। সাহেব তার সাথে আসা কনস্টেবল এর দিকে চাইল।
“আজ্ঞে বড় কত্তা…” ইতস্তত হয়ে বলল গ্রামের ছেলে সদ্য কনস্টেবল হওয়া মুখার্জী, “আমরা একটা দলকে খুঁজছি, মানে সাহেবের মনে হয় ওরা তুলসীপুরেই গা ঢাকা দিয়েছে।”
“কোনো প্রমাণ আছে তোমার সাহেবের কাছে?” গর্জে উঠলেন জমিদার “নাকি সকাল সকাল এমনই চলে এলেন ভয় দেখাতে?” কনস্টেবল চুপ। সাহেবের মুখে ভ্রূকুটি। সে বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতে পারে।
“ত্রিলোচন রায় চৌধুরী কাউকে ভয় পায়না । বলে দাও তোমার সাহেব কে । প্রমাণ ছাড়া যেন এ গ্রামে না দেখি তাকে। আমার পূর্বপুরুষরা পলাশীর পর সমর্থন করেনি এই গোরাদের, তার জন্য তাদের প্রাণ দিতে হয়েছিল। দরকার পড়লে এই ত্রিলোচন....” উত্তেজিত হয়ে হাতির দাঁতের কাজ করা লাঠিতে ভর দেন তিনি।
“আহ দাদা, দাড়াও না আমি কথা বলছি।” বলে ওঠেন ছোট ভাই। কথায় বিভ্রাট ঘটে কারণ চাকর এসে পরেছে পরসেলেন পেয়ালাতে চা নিয়ে। সে চলে যাবার পর একটা চুরুট প্রদান করেন বিনয় সাহেবকে। দাদার সামনে তিনি নিজে খান না, তবে সাহেবকে ক্ষুব্ধ করে কি লাভ? ব্যবসা করতে হবে তাকে। সাহেব মাথা নেড়ে না বলে দেন।
“ We will inform you as soon as we get any news” বিনয় স্বচ্ছ ইংলিশে জানান সাহেবকে, সে মাথা নেড়ে উঠে পরে। এক দৃষ্টে যেতে দেখেন তাদের, বড় জমিদার।
“হুঃ !” মুখ বিকৃত করে বলে ওঠেন ত্রিলোচন “বঙ্গসন্তানের একি দুর্দশা, সাহেবের পা ধরে পড়ে থাকতে হয়।”
“দাদা, আমি তোমায়ে আগেও বলেছি, অনেকবার বুঝিয়েছি। বেকার ঝামেলায়ে পরে কি লাভ? যখন আমরা সত্যিই কিছু জানিনা?” উঠে চলে যান ত্রিলোচন। বিনয় শুনতে পান বাড়ির ভেতর তার হাকডাক “বৌমা? ও মা? বলি আমার ঘরে এসো একবার, আর বিহারী কে বোলো হুকাটা আনতে।”
“আসছি।” হেঁশেল থেকে আওয়াজ শোনা যায়ে বন্দিতার। বিনয় চুরুট ধরান ।
বৌমার উপর যে মেয়ের মতন স্নেহ করেন তার দাদা সেটি সর্বদা ছিলনা। এতদিন ধরে খানিকটা শিখিয়ে পরিয়ে নিজের হাতে সংসার করা শিখিয়েছেন তিনি মেয়েটাকে। তাতেই হয়তো বাপমরা মেয়েটার প্রতি মায়া। কিন্তু যেদিন বন্দিতা প্রথম তুলসীপুরে পা রাখে সেইদিন যেন ঝড় বয়ে গেছিল রায় চৌধুরী পরিবারের উপর। অনিরুদ্ধ বরাবরের জেদি, তা বিনয় জানে। দোষই বা দেয় কি করে? তার পুত্র যে তারই মত। কিন্তু এ কেমন জেদ ? যে ছেলে সকালে জলখাবারে বসে বাল্যবিবাহের ঘোরতর বিরোধ করে, সে কিনা নিজের ভালোবাসা, স্বাভাবিক জীবন ও শান্তি নষ্ট করে স্বেচ্ছায় একটি আট বছরের শিশুকে বাড়ির বউ করে আনে? কি ভেবে? বন্দিতারা গরীব, নিম্ন জাতির.. সে নাহয় বিনয় যদি নাও ধরত, কিন্তু সৌদামিনীর বাবাকে সে কি মুখ দেখাবে? সমাজকে কি বলবে? একটি বিধবা শিশুকে বিয়ে করে আনলো রায় চৌধুরীদের বড় ছেলে? কেন?
“শিশুটিকে এমনই বাঁচানো যেত না ?” গর্জে উঠেছিলেন ত্রিলোচন বাবু, “আর যদি নাই যেত, তোমার কি দরকার ছিল সমাজসেবা করে জীবন নষ্ট করার? মরতে দিতে!”
“সৌদামিনীর বাবাকে আমি কি উত্তর দেবো তা ভেবেছ ?” বিনয় শুধিয়েছিল। সর্বদা তর্ক করা অনিরুদ্ধ তখন বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়েছিল বাবা জ্যাঠার সম্মুখে। কি করে ফেলে আসত অমন নিষ্পাপ প্রাণীটিকে ? নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না সে। সেই অপরাধবোধ নিয়ে সৌদামিনীকে খুশি রাখতে পারত সে? আর বিয়ে না করলে তুলসীপুর আনতো কি পরিচয়ে? সে কি চেনে না গ্রামবাসীদের? চোখ ছলছল করে ওঠে সেদিন অনিরুদ্ধর। থেমে যায় হঠাৎ ত্রিলোচন; মায়ের অকাল মৃত্যুর পর সে আর কাঁদতে দেখেনি কোনদিন অনিরুদ্ধকে। অনিরুদ্ধ হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে নেয় সেদিন। সে সৌদামিনীর অপরাধী, কিন্তু কেন জানি সিঁদুরের রঙ ললাটে রাঙানোর সাথে সাথে বন্দিতার প্রতি এক তীব্র দায়িত্ববোধ জন্মায় তার। বাবা জ্যাঠার কুকথা ও ভাইদের অবাক দৃষ্টির মাঝে সে পেছনে ফিরে দেখে বিস্ময় ভরা দুটি চোখ চেয়ে আছে তার দিকে। ভয় পেয়েছিল কি সেদিন বন্দিতা? তা পেতে পারে, সে তো আর তখন জানত না কেমন নিত্য লেগে থাকে রায় চৌধুরীদের বড় ছেলের জেদ। এখন সেই বন্দিতা যার গৃহপ্রবেশ করতে চাননি জমিদারবাবু তাকে ছাড়া বাড়ি অন্ধকার। সময় ভারী আশ্চর্য জিনিস।
“একি বাবা, কাজে বেরবেন না?” বিনয় তার দ্বিতীয় সন্তান সোমনাথের দিকে চাইলেন , “খাজাঞ্চী বাবু হাজির যে।”
“চলো।” উঠে পড়লেন তিনি।
বন্দিতা বিহারী বাবুকে সাথে নিয়েই ত্রিলোচনের ঘরে ঢুকল। বিহারী বাবু সদ্য সাজানো গড়গড়িটা জমিদারবাবুর সম্মুখে রেখে বেরিয়ে গেল আর আরাম কেদাড়ায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকা ত্রিলোচন মুখ তুলে চাইলেন বৌমার দিকে।
“বিনয় বেরিয়ে গেল বুঝি?”
“এই তো সবে” বন্দিতা মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলো , “কিছু বলতে হতো বুঝি?” জিজ্ঞাসা করল সে, “তাহলে বিহারীবাবুকে বলছি।”
“না না “ হঠাৎ গলা নামালেন ত্রিলোচন “বলছি ওই ছেলেগুলোর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা.. “
“সে নিয়ে আপনার কি চিন্তা? আগে যেন এমন হয়নি?” বন্দিতার চোখ কুচকে গেল “আমি আর কোয়েলি দিদি ছাড়া কেউ জানবেনা । কোয়েলি দিদি হেঁশেল থেকে খাবার দিয়ে আসবে। আমিই যেতে পারতাম যদি আপনি ব্যারিস্ট্রা বাবুকে বলতে দিতেন কোয়েলি দিদিকেও বলার দরকার হতোনা।”
“তাকে বলে আর কাজ নেই।” ত্রিলোচনের কথায়ে হেসে ফেলল বন্দিতা। সে একা না, এবাড়িতে সবাই কম বেশি ভয় করে অনিরুদ্ধকে। “আর তোমার গিয়েও কাজ নেই ।”
“বেশ মজা হতো।” হঠাৎ তার কথায় কৌতূহলের দৃষ্টিতে চাইলেন জমিদারবাবু “কোনদিন বিপ্লবী দেখিনি, মানে কেমন দেখতে হয় ঠিক" হো হো করে হেসে ফেললেন ত্রিলোচন বন্দিতার কথায়।
“তা মানুষের মতনই হয়, নিজের স্বামীকে দেখোনা?” হঠাৎ কেমন লজ্জিত বোধ করে রায় চৌধুরী গিন্নি। সে এখন বড় হয়েছে, অন্য কেউ স্বামীর ব্যাপারে পরিহাস করলে লজ্জা লাগে বইকি এ তো স্বয়ং শ্বশুরমশাই।
“উনি কি আর বিপ্লবী?” লজ্জিত সুরে বলে ওঠে বন্দিতা।
“তা বৌমা, বিপ্লবী কি শুধু এক প্রকারের হয়?” ত্রিলোচনের কথায় অবাক হয়ে চায় সে, “এই যে তোমরা তুলসীপুরে কি প্রচন্ড বিপ্লব ঘটিয়ে মেয়েদের বাড়ির বাইরে পড়তে আনলে, তা কি কম সাহসের কথা?” বন্দিতা সায় দেয়, তারপর শ্বশুরমশায়ের হাতে গড়গড়ার নল ধরতে দেখে চলে যায়ে পড়ার ঘরে। বইয়ের পাতা উল্টতে শুরু করে সে। অনেক কাজ বাকি।
Comments
Post a Comment