কলকাতার মেয়ে
সৌদামিনী সুভাষিণী, সুন্দরী ও সুলক্ষণা। কলকাতাতে দীর্ঘ দিন থেকে সে অনুভব করে এই পৃথিবীটা তুলসীপুর ও রায় চৌধুরী বাড়ির থেকে অনেক বড়। অনিরুদ্ধ বিলেত থেকে লেখা চিঠিতে জানায় তাকে লন্ডনের কথা। সেই অজানা পৃথিবী দেখার ইচ্ছা হয় সৌদামিনীর। আর তার মনের অন্ধকারে আলো হয়ে দাঁড়ায় অনিরুদ্ধ। তার হাত ধরেই সে মুক্তি পাবে তার ছোট্ট পৃথিবী থেকে, আর পারি দেবে সুদূর বিদেশে। অনিরুদ্ধের ভূমিকা তার জীবনে এইটুকুই থেকে যায়, একটা দরকার মাত্র; একটি স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি। প্রেম পত্র আদান প্রদানের প্রথাটা মন্দ লাগেনা তার, তাই অনেক কথা শুধু শুনতে ভালো লাগছে বলে না ভেবেই লিখে দেয় সে। তার কি দোষ ধরা চলে তাতে ? তার পৃথিবীতে অনিরুদ্ধ ছাড়া কোনো পুরুষের আগমন ঘটেনি সেই ছোটবেলা থেকে। ভালোবাসা তার কাছে শরৎচন্দ্রের লেখা উপন্যাস মাত্র। তার আর কোনো অর্থ বোঝেনা সে। তবে যেদিন বাবা ম্লান মুখে এসে বলে তুলসীপুরে ঘটে যাওয়া সেই মহাপাপের কথা, এবং অনিরুদ্ধের পাগলামির নমুনা, যার দরুন সে নাকি আর বিদেশেই যাবেনা, হঠাৎ যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে সৌদামিনী। একদিকে মনে মনে ভাবে কলকাতার জীবনযাপনের পর তার পক্ষে সম্ভব হতনা গ্রামের বউ হয়ে ওঠা, অন্য দিকে সে চিনতে চায় সেই মেয়ে কে যে অজান্তে তার এত বড় উপকার করেছে। সৌদামিনী সেদিন প্রথমবার নিজের কাছে স্বীকার করে একটা কঠোর সত্য যা বুকের কোণে লুকিয়ে সে বেঁচে ছিল এতদিন এক স্বপ্ন পূরণের আশায়। সে কোনদিন অনিরুদ্ধকে ভালোবাসেনি । ভালো বেসেছিল লন্ডন যাবার স্বপ্ন কে, ভালো বেসেছিল অনিরুদ্ধের অজুহাতে পাওয়া এই জীবনটাকে, তার ইংলিশ গান, পার্টি ও বইগুলোকে; এই বিরাট পৃথিবীটাকে যেটার ঠিকানা জানতনা সে। সৌদামিনীর বয়েস তখন হয়তো আঠেরো। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বাবাকে দেখে একবার মাত্র অল্পক্ষণের জন্য অনিরুদ্ধের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল সে। তারপর সে ঠিক করেছিল নিজের ভবিষ্যৎ নিজের দায়িত্বে গড়বে। পড়াশুনয়ে মন দেয় সে।
বছর দুই আগে হঠাৎ একদিন তার দরজায় এসে দাড়ায়ে অনিরুদ্ধ। সত্যি বলতে চিনতেই পারেনি সে এতদিন পর তাকে। হয়তো তাকে নিজের দোড়গোড়ায় আশা করেনি বলেই। ক্ষমা চায় অনিরুদ্ধ, খুশি হয় জেনে যে বাচ্চাদের পড়ায়ে সৌদামিনী, কলেজেও যায়ে। খানিকটা ইতস্তত করে বলে বন্দিতার কথা। মেয়েটি মেধাবী। তাকেও কলেজ পাঠানোর ইচ্ছা তার।
“তা বেশ তো! আমার কাছে নিয়ে আসবেন, আমি শিখিয়ে পড়িয়ে দেব, ইন্টারভিউ তে কোনো সমস্যা হবেনা। আমার দক্ষিণা হিসেবে ওই গরীব বাচ্চাগুলোকে কিছু বই দেবেন।” তার প্রস্তাবে হাসে অনিরুদ্ধ। জানায় তার সবে দশ বছর বয়েস। অবাক হয় সৌদামিনী। বয়েস না বললে, অনিরুদ্ধের কথা শুনে মনে হত খুব ভালোবাসে সে স্ত্রী কে, এখন মনে হল, স্নেহ করে। দুটো কি আলাদা? তা তো জানেন সৌদামিনী। শুধায় সোমনাথ, বটুক ও পরিবারের কথা। অনিরুদ্ধ হয়তো কিছুটা অপরাধবোধেই তাকে সাহায্য় করতে চায়। আসে তার শিষ্যদের নতুন বই। শেষমেশ অপরাধ বোধে সত্যিটা তাকে বলে ফেলে সৌদামিনী, তাকে সে কোনদিন ভালোবাসেনি। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য দরকার ছিল তার। ক্ষমা চায়। ভয় তাকায়না তার দিকে। অনিরুদ্ধ কোনো কথা না বলে চলে যায় সেদিন। সৌদামিনী ভাবে সেই শেষবার দেখবে সে রায় চৌধুরী বাড়ির কাউকে। অনিরুদ্ধের অভিমান হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তার দু’সপ্তাহ পর চিঠি আসে তার নামে, তুলসীপুরে পুজোর নিমন্ত্রণ। আবার শুরু হয় এক নতুন সম্পর্ক। তুলসীপুরে যাতায়াত। বন্ধুত্ব। সোমনাথ, অনিরুদ্ধ ও বটুকের সাথে তো বটেই, বন্দিতার সাথেও। তার মতো গুণী মেয়ে খুব কম দেখেছে সৌদামিনী। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক লাগে তার। এত গুণ তার নিজের, ইংলিশ জানে, বুনতে পারে, রান্না করতে পারে কত রকম ইংলিশ বেকিং জানে। পার্টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতন রূপ তার। তবুও কোনদিন বিলেত ফেরত অনিরুদ্ধের যোগ্য মনে করেনি সে নিজেকে। আরো ভালো হতে চেয়েছে বার বার। কিন্তু বন্দিতা? কতই বা বয়েস তার? প্রশ্নের ফুলঝুরি ঝরে মুখ দিয়ে। ইংরিজি শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে হোচট খেয়ে হেঁসে ফেলে সে তবু শেখার ইচ্ছা প্রবল। গিন্নি সে রায় চৌধুরীদের। অধিকারের সাথে শাসন করে ঠাকুরপোদের, খেয়াল রাখে শ্বশুরদের । নিজের তর্ক দিয়ে পার্থক্য আনতে চায়ে সে সমাজে। দেশের নারীদের কল্যাণের জন্য অনেক স্বপ্ন তার কচি মনে। সেই সব স্বপ্ন পূরণ করবে তার স্বামী, কেমন সহজেই বলে ফেলে সৌদামিনীকে সে সেসব কথা। এগারো বছরের বন্দিতার পরী দিদি হয়ে ওঠে সে। “তোমায় কি সুন্দর দেখতে গো দিদি, ঠিক পরীর মতন।” হেসে বলে সে।
“তোমকেও সুন্দর দেখতে, ভাই।”
“ধুর, তোমার মত না মোটেও। তুমি তো কলেজ যাও , কত কি জানো ।” বন্দিতার প্রশ্নবান শুরু হয় তার পরেই, কলেজ কেমন জিনিস তা নিয়ে।
অনিরুদ্ধকে বন্দিতার দিকে বারবার গর্বের সাথে চাইতে দেখেছে সৌদামিনী। সেরকম সে তাকে কোনদিন দেখেনি, এমনকি সোমনাথ যখন ক্লাসে প্রথম হল সেদিনও না। হয়তো এটাই নিয়তি, এটাই ভালোবাসা। বন্দিতা আর অনিরুদ্ধ জানেনা তাদের কাছে যা আছে তা কতটা মূল্যবান। অনিরুদ্ধকে বললে অস্বীকার করবে সে, কারণ বারংবার সে সবাইকে মনে করিয়ে দেয়, বন্দিতা শিশু, তার পুতুলখেলা ও পড়াশুনার দিনগুলো তাদের সম্পর্কের বন্ধনে বাধতে চায়না সে। সম্পর্কটা থেকে যাবে, কিন্তু স্ত্রীর শিক্ষার প্রতি সে কোনো বাধা চায়না। সৌদামিনী বোঝে সেটা, কারণ প্রথমবার তাদের দেখে তার মনে হয়, শরৎচন্দ্রের লেখার বাইরে জগতেও প্রেম আছে, এবং তা সে স্বচক্ষে দেখেছে।
Comments
Post a Comment