অনন্যা
সৈকত চট্টোপাধ্যায় অনিরুদ্ধর বাল্যকালের বন্ধু। তারা একই স্কুলে পড়ত ঠিকই কিন্তু যখন সৈকত কলকাতায় কলেজ করতে যায় ও অনিরুদ্ধ পাড়ি দেয় সুদূর বিদেশে, তাদের কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনিরুদ্ধ ফেরার পর, যা ঘটে, তা না চাওয়া সত্যেও জানাজানি হয়ে যায় আসে পাশের গ্রামেও। রায় চৌধুরীরা দিনাজপুরের খুব নাম করা পরিবার সে বিষয় সন্দেহ নেই। খানিকটা কৌতূহলের বশেই অনিরুদ্ধকে আবার যোগাযোগ করে সৈকত। অনিরুদ্ধ সব ঘটনা তাকে খুলে বললে সে তুলে ধরে অনিরুদ্ধর সামনে একটি কঠোর বাস্তবের চিত্র । বন্দিতা যে তার বিয়ে করা বউ, তা সে অস্বীকার করলে মেয়েটার দোষ দেখবে সমাজ, না জানি কি কথা শোনাবে তাকে। এখন সে ছোট কিন্তু বড় হলে যখন বুঝতে শিখবে, বিনা দোষে দোষী বোধ করাবে তাকে সবাই। অনিরুদ্ধ যতই বাল্যবিহাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক না কেন, কিংবা যতবার বলুক সে কেন বন্দিতাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে, সত্যিটা সকলের কাছে এইটুকু যে তার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে তাকে নিজের পরিচয় দিয়েছে অনিরুদ্ধ। সে সেই পরিচয় অস্বীকার করতে পারেনা। সৈকতের কথাতেই হয়তো প্রথম বার, তার ভবিষ্যত নিয়ে আঁকা মনের ভেতরের চিত্রটিতে বন্দিতা স্থান পেয়েছিল, এবং সেদিনই অনিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয় বন্দিতাকে লেখাপড়া শেখানোর। বন্দিতার আসা যাওয়া সৈকতের বাড়িতে তখন থেকেই, তার বিধবা মা স্নেহ করত তাকে, ও তার মধ্যেই হয়তো ছোট মেয়েটা খুঁজে পেতো মাতৃতুল্য কাউকে।
সৈকতের বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজো হয় প্রতিবার। অনিরুদ্ধ ব্যাস্ত থাকলে বন্দিতা একাই যায় সেখানে। সৈকতের বোন লীলার সঙ্গে তার খুব ভাব। তার ক’বছর হলো বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সন্তান না হওয়ায় ভারী চিন্তায় সৈকতের মা। সেবার যখন বন্দিতা নেমন্তন্ন রক্ষা করতে গেলো চাটুজ্জীদের বাড়ি, যেন কেমন কষ্ট লাগলো লীলাদিদিকে দেখে তার। তার চোখের তলায় কালি, অন্য মহিলারা যেখানে একসাথে বসে তাদের স্বামী পুত্র সংসারের গল্প করছিল ঠাকুর দালানে, বন্দিতা তাকে দূরে একা বসতে দেখে এগিয়ে যায় সেদিকে।
“ভালো আছিস সই?” জিজ্ঞেস করে লীলা। মাথা নাড়ে বন্দিতা তারপর বসে পরে তার পাশে।
“তোমার সংসার কেমন চলছে দিদি?” জিজ্ঞেস করে তাকে। ম্লান হাসে লীলাদেবী।
“আমার বোধ হয় আর সংসার টিকবেন।” অতি কষ্টে গলা না কাঁপিয়ে বলে লীলাদেবী।
“সে কি দিদি। কি হলো?” বন্দিতার মুখে ভ্রূকুটি।
“উনি এবার মাকে বলে গেলেন, পরের বছরের মধ্যে কিছু একটা না হলে আমায় ফেরত দিয়ে যাবেন, আবার বিয়ে করবেন।” তার চোখ ছলছল করে।
“তা তিনি কি করে জানেন তোমার দোষ?” প্রশ্ন করে বন্দিতা। আঁতকে ওঠেন লীলাদেবী।
“কি বলছিস তুই? আর কি হতে পারে?” বলে ওঠেন তিনি। “উনি সবাইকে বলে রেখেছেন জানিস, কি আর বলব বল? সবাই তো আর তোর মত স্বামী ভাগ্য করে আসেনা।” হঠাৎ তার কথায় পরীদিদির বলা সব কথা মনে পরে যায় তার। তারপর থেকে আর ঠিক করে কথা বলেনি সে ব্যারিসট্রা বাবুর সাথে। তিনি তিন দিন জ্বরের পর ব্যস্ত হয় পরেন এবং বন্দিতার পরীক্ষা সামনে। তা ছাড়া কি বলবে সে অনিরুদ্ধকে?
“কি করবে তুমি?” জিজ্ঞেস করে বন্দিতা।
“মা এক দাইমাকে ডেকেছেন।” বলেই থেমে যায় লীলা, তার মা এসে ডাকে তাকে। বন্দিতাকেও আসতে বলেন ঘরের ভেতর। তার ছেলে এখনো বিয়ে করেনি তাই, নাহলে তার ঘরেও বন্দিতার মত একটি বউ হত এতদিনে।
এক প্রৌঢ় মহিলা বেশ গোলগাল চেহারা তার, এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে লীলাদেবীর দিকে, তারপর এগিয়ে এসে তার নাড়ি পরীক্ষা করে, চোখ দেখে, তারপর তার সাথের ঝোলা থেকে বের করে কয়েকটা শিশি ও জরিবুটি।
“এইটে রাখো মা।” কয়েকটা পাতা বেটে একটা বোতলে তার রস ভরে বলে সে লীলাদেবীর মা কে, “এইটে খাওয়াও তো ছয় মাস। তারপর দেখো, কোল আলো করে ছেলে না এলে, আমার নাম বদলে দিও।” লীলাদেবীর মা সেটি হেসে নিয়ে নেয়।
“তুমি বলো বাছা।” হঠাৎ বন্দিতার দিকে চায় সে “তোমারও কি একই সমস্যা?”
বন্দিতা মাথা নেড়ে না বলতে যায়।
“হ্যাঁ বাছা তোমারও তো বিয়ে হলো বহুদিন, তোমার তো বাড়িতে শাউড়ি নেই, মাও থাকেন কত দূরে, তারা থাকলে তোমায়... “ হঠাৎ মাসীমার কথায় কেমন চুপ করে যায় বন্দিতা।
“ওকে দেখে দাও তো বউ, লজ্জা কিসের? আমি তো তোমারও মায়েরই মত ।” দাই এগিয়ে আসে, বন্দিতার নাড়ি পরীক্ষা করতে। চাইলে বন্দিতা পারত তাকে মানা করতে, কিংবা অন্য কোন অজুহাত দিতে। সে তাকায় কাকিমা ও বসে থাকা মহিলাদের দিকে। যদি সে কিছু বলে তাতে রঙ চড়িয়ে যে কি না কি গল্প তৈরি হবে তার ঠিক নেই, এবং মানা করলে হয়তো মাসীমা কষ্ট পাবেন। তাই চুপ করে থাকে সে। দাই বোতল এগিয়ে দিলে, নিয়ে নেই। মনে মনে ভাবে রেখে দেবে কোথাও আর পরেরবার পুজোয় হয়তো ভুলে যাবেন মাসীমা।
সেবার বর্ষায় জ্বরজারি হচ্ছে ভারী, সবাই ভুগছে, তারই মধ্যে হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে থেকেই কেমন অস্বস্তি লাগলো বন্দিতার।
অনিরুদ্ধ চুল আচড়াচ্ছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সে দেখলো বন্দিতার মুখে যেন বেদনার আভাস।
“কি হয়েছে তোমার?” জিজ্ঞেস করে সে, “শরীর খারাপ নাকি?”
“না... মানে... একটু “ বসে পরে সে খাটের এক পাশে, “পেটটা ..."
“ডাক্তারের কাছে যাবে? ওষুধ... “
“না আমি ঠিক আছি। বদহজম হয়েছে বোধ হয়।” মাথা নাড়ে বন্দিতা। “আপনি যান, দেড়ি হয়ে যাবে, দুগ্গা দুগ্গা।”
“কোয়েলিকে বোলো যদি কিছু... “ অনিরুদ্ধ থেমে যায়।
“আপনি চিন্তা করবেন না। যান।”
অনিরুদ্ধ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় গাড়ি বারান্দার দিকে।
হঠাৎ দেখে এক মধ্যবয়েসী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, ইতস্তত করছে ভেতরে আসতে।
“কাউকে খুঁজছেন?” জিজ্ঞেস করে অনিরুদ্ধ।
“হ্যাঁ, গিন্নিমা ... “
“বলুন কি দরকার, আমি ওনার স্বামী হই ।”
“ওহ” হেসে ফেলে মহিলা, তার ঝোলা থেকে বের করে একটি বোতল। “এইটে দিয়ে দেবেন ওনাকে?”
“কি এটা?” জিজ্ঞেস করে অনিরুদ্ধ, তার মুখে ভ্রূকুটি।
“এটা দাইমা পাঠালেন, ওনার ছ’ মাসের ওষুধ তো শেষ বোধ হয়।” অনিরুদ্ধ অবাক, কিসের জরিবুটি খায় বন্দিতা? কেন? বিলীতি ওষুধ এনে দেয় তো সে দরকার হলে।
“দাই মা বললেন ভালো খবর দিয়েছেন লীলা দিদিমনি কিন্তু তুলসীপুর থেকে যখন আসেনি, আর এক বোতল দিয়ে আয় জমিদার গিন্নিকে।”
হঠাৎ আলোকপাত হয় অনিরুদ্ধের মনে। “বন্দিতা নিজে গেছিলো তার কাছে?” অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করে সে।
“তা তো আমি জানিনে, হ্যাঁ তবে ওই গ্রামের লীলাদির সাথেই তো নিয়েছেন ওষুধ... “ হঠাৎ পকেট থেকে টাকা বের করে অনিরুদ্ধ।
“এই নিন, এটা রাখুন, আর আসবেন না।” মহিলা অবাক দৃষ্টে তাকায় তার দিকে।
“তার মানে? ওষুধটা... ”
“ওটা নিয়ে যান।” কেমন যেন তারা দেয় অনিরুদ্ধ।
“সে কি!” হঠাৎ চেচিয়ে ওঠে মহিলা “আধা ওষুধ খেলে যে হিতে বিপরীত হতে পারে!”
“যাবেন আপনি? নাকি ... “ অনিরুদ্ধর স্বরে ভয় হয় তার। জমিদারকে রাগিয়ে কে কবে গ্রামে টিকতে পেরেছে? দ্রুত পায়ে চলে যায় সে। অনিরুদ্ধর মুখে ভ্রূকুটি, ভয় পায় সে, তবে কি এই কারণে শরীর খারাপ বন্দিতার? হঠাৎ এ কেমন ভূত চাপল তার মনে? চিন্তা হয় অনিরুদ্ধের। তাহলে কি কিছুই জানেনা সে? নারী হয়ে উঠেছে বন্দিতা স্ত্রীহিন সংসারে, তবে কি জ্যাঠা মশাইয়ের কথাই ঠিক? কয়েলীর বোঝানো উচিত ছিল তাকে যা অনিরুদ্ধ পারেনি?
“অনিরুদ্ধ বাবু?” হঠাৎ দেবাদিত্যর স্বরে চকমে তাকায়ে সে। “শহরে যাবেন আজ?”
“হ্যাঁ। তুমি বাগচীদের বাড়ির উইলটা খুঁজে রাখো, আমি একটু আসছি।”
“অনিরুদ্ধ বাবু? একটা কথা ছিল।” তাকে থামায় দেবাদিত্য। তার মুখে কিন্তু কিন্তু ভাব।
“কি হয়েছে? বৌঠান ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, কিন্তু মা যেভাবে সেদিন ছোট মালকিনকে ... বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি দুঃখিত।” হঠাৎ তাকে হাত জোর করতে দেখে অবাক অনিরুদ্ধ।
“আমি তো জানতেই পারতাম না সম্পূর্ণা না বললে।”
“কি হয়েছে?” অনিরুদ্ধর প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবাদিত্য। তারপর তাকে সব খুলে বলে দেবাদিত্য। কেমন কুসংস্কারছন্ন সমাজে কথা শুনতে হয় বন্দিতার মত অনেককে। অনিরুদ্ধ বোঝে দেবাদিত্য যা বলছে তা একটি অংশ মাত্র। আসল সত্যটা আরও নিষ্টুর। তবে কি এইসব কথায় কষ্ট পেয়ে বন্দিতার এই চেষ্টা? তাই কি তাকে কোনদিন জানতে দেয়নি লোকের বলা না বলা কুকথা? আরও বিচলিত হয় অনিরুদ্ধ। যে বয়েসে তার পড়াশুনা করে ভবিষত্য়ের চিন্তা করা উচিত, সেই বয়েসে মা হতে চায় সে? শুধু কি সমাজের প্রত্যাশা নাকি তার নিজের কুসংস্কারছন্ন মনের একটি সুপ্ত বাসনা? তাকে কি কেউ বুঝিয়েছে যে মা হওয়াই তার জীবনের লক্ষ? বোঝালেও আশ্চর্য হবেনা অনিরুদ্ধ। বন্দিতার নিষ্পাপ মনে কি প্রভাব পড়েছে তার? ভাবতেও পারেন সে। হঠাৎ রাগ হয় অনিরুদ্ধর। কেন কিছু বলে না তাকে? দ্রুত পায় ঘরের দিকে চলে যায় সে।
বন্দিতা খাটের কোনে বসে একটা বই পড়ছিল। হঠাৎ স্বামীকে ঘরে দেখে অবাক সে।
“কিছু ভুলে গেছেন?” জিজ্ঞেস করে মৃদু হেসে, স্বামীর মুখের গম্ভীর ভাব দেখে হাসি ম্লান হয়ে যায় তার। “কি হয়েছে?”
“তুমি বলো কি হয়েছে।” তার কন্ঠে ক্রোধ। “আর কি কি বলো নি আমায়? আর কি কি মিথ্যা বলো?”
“মানে?” হাতের বইটা রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে বন্দিতা। কি জানে অনিরুদ্ধ? পরী দিদির কথা সে জানলো কি করে?
“তোমায় আমি অনেকবার বুঝিয়েছি বন্দিতা, বলো বোঝাইনি?” কেমন হতাশ ভাবে বলে সে, “তুমি তো অন্যদের থেকে আলাদা, অনন্যা। তুমি কেন তাদের মত মধ্যবিত্ত হয়ে বাঁচতে চাও? আমাদের স্বপ্ন, তোমার বড় হওয়ার আশা, সব কিছু ... “
“আপনি কি বলছেন? আমি তো কিছুই... “ বন্দিতা বোঝার চেষ্টা করে, “আমি কি অন্যায় করেছি?” কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞেস করে সে।
“তুমি কেন অন্যায় করবে? অন্যায় আমি করেছি। তোমায় ভুল বুঝেছি, ভেবেছি আমার বন্দিতা মেয়েদের চলার পথে আলো হবে। অন্যদের পথ দেখাবে। সে অন্যরকম। কোনদিন ভাবিনি তুমি অন্যদের মতই নিপীড়ত ভাবে বাঁচতে চাও, আমারই ভুল।” যেভাবে ঘরে এসেছিল সেই ভাবেই বেরিয়ে যায় অনিরুদ্ধ। বন্দিতার চোখে জল, সে বসে পরে ঘরের মেঝেতে। কেন বললেন তিনি এসব কথা? তবে কি তার স্ত্রী হয়ে ওঠার প্রচেষ্টাকে এতটাই ঘৃণা করেন ব্যারিস্টার বাবু? তিনি কি ক্ষুব্ধ পরী দিদির সাথে তার কথোপকথনে? কিন্তু সে তো কিছুই জিজ্ঞেস করেনি তাকে। তবে কিসে রেগে গেলেন তিনি?
কয়েলীর ডাকে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়ে বন্দিতা।
“ওই দাইমার বাড়ির বউ এসেছিল আপনার কাছে, আমার সাথে ঘাটে দেখা হতে বললে, ছোট কত্তা তাকে বের করে দিয়েছেন বাড়ি থেকে।” ভয় ভয় বলে সে। বন্দিতার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তাহলে তিনি জানেন সেই জরিবুটির কথা? তাকে কি ভুল ভাবছেন তিনি? ভয় হয় বন্দিতার।
Comments
Post a Comment