উপলব্ধি
“বুঝলাম, জানলাম, শিখলাম।” বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে বন্দিতা। “কিন্তু আমি কি আর ছোট আছি?” হেসে বলে সে, “দেখেন না আপনি? আমি কি আর পুতুল খেলি নাকি?” হাক দেন ত্রিলোচন বাবু “বৌমা, চাটা পাবো কি?” সারা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় বন্দিতা। হঠাৎ যেন তার কথা মনে ধরে অনিরুদ্ধের। সত্যি আর পুতুলের বায়না করেনা সে বহুদিন হল। আগে বন্দিতার পুতুলের বিয়ে হলে সে কি হুলুস্থুল কান্ড হত বাড়িতে। কয়েলি ভালোমন্দ রান্না করত, সম্পূর্ণা আসত, বটুক হত বরকত্তা। মাঝে মধ্যে সৌদামিনীও আসত বন্দিতার জন্য বিদেশী doll নিয়ে। অনিরুদ্ধ খেয়াল করেনি কবে বন্দিতার পুতুল খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। সত্যি কেমন গিন্নি হয়ে উঠেছে সে।
সকাল থেকে গ্রামের লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকে। বন্দিতাও ব্যস্ত রান্নাঘরে। কিছু মহিলারা আসেন গ্রাম থেকে সকাল সকাল ভোগ রান্নায় সাহায্য করতে। বন্দিতার এক পলক সময় নেই তখন। অনিরুদ্ধের চাও আজ বিহারী করে দেয়। এক চুমুক দিয়ে বিরক্ত লাগে তার। ভাল হয়েছে কিন্তু বন্দিতা অনেক বেশি ভাল বানায়। বৌমার সব কাজের যত্ন নিয়ে অনেক প্রশংসা জেঠামশাইয়ের। আজ যেন তার মর্ম বোঝে অনিরুদ্ধ। একটা ফাইল হাতে পড়ার ঘরে চলে যায় সে।
এদিকে সব রান্না সারতে প্রায় বিকেল গড়ায় বন্দিতার।
“ঠাকুরমশাই আসার আগে তৈরি হয়ে নাও বউরাণী।” কয়েলীর কোথায় সম্পূর্ণা হাতের কাজ সেরে উঠে পরে। “আজ আমি সাজিয়েদি?” জিজ্ঞেস করে সে। বন্দিতা দিদির ইচ্ছায় মাথা নাড়ে। সন্তান না হওয়ায় যা যা শোনে সম্পূর্ণা তার শাউড়ির কাছে তা অজানা না বন্দিতার । ছোটবেলা তাকে সাজাতে সাজাতে বারংবার বলতো দিদি তার খুব মেয়ের শখ। তাকে সাজাবে, নিজের মতো করে। মামী অবশ্য তাতে রেগে যেত “এমন অলুক্ষুণে কথা মুখে আনে কেউ? ছেলে হলে ঘর আলো হয়।” বন্দিতার তখন মাথায় ঘোরে প্রশ্নবান। “তাহলে তোমার বাড়িতে পিদিম জ্বলে কি করে মামী?” কথার উত্তরে পড়েছিল মার। সাজানো শেষ হয়নি সেদিন সম্পূর্ণার। একটা দিকে বেনি নিয়ে দৌড়ে বেরচ্ছিল বন্দিতা তাদের উঠোনে, পেছনে ঠেঙ্গা হাতে মামী। আজ সাজাবে সে বোনকে যত্নে। এত বছরের আশা তার।
“এই শাড়ীটা ?” একটা লাল বালুচরী শাড়ী তুলে ধরে হাতে সম্পূর্ণা। “এইটা উনি কলকাতা থেকে এনে দিয়েছিলেন প্রথমবার পুজোয়।” মনে পরে বন্দিতার। “তখন আমি ছোট ছিলাম তো, সামলাতে পারতাম না।”
“এখন পারবি।” সম্পূর্ণা শাড়িটা ধরিয়ে দেয় বন্দিতার হাতে। “আমি ছেড়ে আসি, তুমি ওই বাক্স থেকে গয়না গুলো বের করে রাখো, দিদি।” বন্দিতা দেখিয়ে দেয় আয়নার কাছে তাকে রাখা বাক্স। সেদিকে গিয়েও থেমে যায় সম্পূর্ণা। তার মনে পরে স্বামীর কথা। তারা মনিব। দূরত্ব বজায় না রাখলে শেষে যদি বিপদে পর কোথায় যাব আমরা? গয়নার বাক্সটা বেশ বড়। কৌতুহল হয় সম্পূর্ণার। কিন্তু সামলে নেয় সে। তার বোন আজ জমিদারবাড়ির বড় বউ। তার গয়না থাকবে তাই তো স্বাভাবিক। তার মতো অভাগী নয় বন্দিতা। শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসে বন্দিতা। “এ কি দিদি? গয়না বের করনি ?”
“তোর পছন্দের তুই পর ভাই, আমি বুঝিনা।” হেসে বলে সম্পূর্ণা। “আয় আমি কাজল লালী পরিয়ে দি।”
“লালী পরলে উনি বকবেন দিদি, সেবার মনে নেই?”
“ধুর বোকা, তখন ছোট ছিলিস তুই। আজ বাড়িতে অনুষ্ঠান, তুই না সাজলে হয়?” সম্পূর্ণা কথা শোনে না বন্দিতার। সত্যি সে অনেক বড় হয়ে গেছে। একা একা দিব্যি শাড়ি পড়েছে। সম্পূর্ণা চলে যায় । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি গয়না পরতে বসে বন্দিতা।
অনিরুদ্ধ সোমনাথের তাড়ায় বিরক্ত হয়েই ঘরে ঢোকে সেদিন। ঢুকেই তার চোখ পড়ে বন্দিতার উপর। খাটের কোণে বসে গয়না পড়ছে সে। হাতের চুরি, মানতাসা, আংটি, সীতাহার, দুল সব বের করেছে। হঠাৎ শাড়িটা চিনতে পারে অনিরুদ্ধ। সেবার খুব ইতস্তত করে প্রথমবার শাড়ি কিনেছিল সে। জ্যাঠামোসাইয়ের আদেশ। বা হয়তো বন্দিতাকে তার মায়ের জন্য মহালয়ার দিন কাঁদতে দেখে অনুশোচনা। ছোট বন্দিতার সেই শাড়ী সামলাতে হিমশিম অবস্থা। তারপর আর পড়তে দেখেনি তাকে এই শাড়িটা। তাকে দেখে মুখ তুলে চায় বন্দিতা। “আপনার পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি।” আঁচলে চাবি বেঁধে বলে সে, “তাড়াতাড়ি চলে আসবেন নিচে।” বন্দিতা ভয় ভয় তাকায় স্বামীর দিকে, লালী দেখে এই বুঝি বোকা দিলেন উনি। কিন্তু কথা বেরোয়না অনিরুদ্ধের মুখ থেকে। মাথা নাড়ে কেবল। প্রথমবার কেমন বড় লাগে বন্দিতাকে, যেন নতুন করে দেখছে সে স্ত্রীকে। নিজের এই উপলব্ধিতে অস্বস্তি বোধ করে অনিরুদ্ধ। বন্দিতার উপর বারংবার নজর যায় তার সারা সন্ধ্যে। দু একবার অপ্রত্যাশিতভাবে চোখাচোখি হলে কেমন লাগে অনিরুদ্ধের। সারাদিন পর সবাই চলে গেলে যখন ঘরে আসে বন্দিতা, অনিরুদ্ধ তখন পড়ার ঘরে। ক্লান্তভাবে খোপার জুইয়ের মালা খুলে ফেলে সে। গয়না গুলো খোলে এক এক করে। সবে শাড়ি বের করতে যাবে, এমন সময় কয়েলি এসে জানায়, “ছোট মালিক ডাকছেন আপনাকে, পড়ার ঘরে।” হঠাৎ রাগ হয় বন্দিতার। এত খাটনির পর পড়তে হবে তাকে? কোন দয়মায়া নেই ব্যারিসট্রা বাবুর? কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে, এমনই একটা মনভাব নিয়ে সে যায় পড়ার ঘরে। অনিরুদ্ধ হাতে কাজের খাতা নিয়ে পায়চারি করছিল ঘরে, তার পরিচিত নূপুরের আওয়াজে মাথা না উঠিয়েই “এস” বলে সে।
“আপনার কি কোন দয়া মায়া নেই?” হঠাৎ তার ক্ষুব্ধ কন্ঠস্বরে বিস্ময় নিয়ে তাকায় অনিরুদ্ধ। দেখে বন্দিতা শাড়ি ছাড়েনি , তার চুল খোলা, ঢেউয়ের মতো, মুখ ক্লান্ত, ভ্রূকুটি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। গলা খাখরায় সে। “মানে ?”
“এখন আমি পড়তে বসবো না। কিছুতেই না।” মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় বন্দিতা। হেসে ফেলে অনিরুদ্ধ। “কে বলেছে পড়তে ডেকেছি?” হাতের খাতাটা বন্দিতার দিকে এগিয়ে দেয়, “এটা পড়ে বলো তোমার কি মনে হয়।” বন্দিতা জানে ওই খাতায় আছে আসামীর বয়ান। তাকে পড়িয়ে পড়িয়ে জিজ্ঞেস করে অনিরুদ্ধ তার কি মনে হয়। বন্দিতা জানেনা সে কোন সাহায্য করতে পারবে কিনা, কিন্তু সে চেষ্টা করে। খাতা পড়তে পড়তে অভ্যেস বসত ঘরে পায়চারি করে সে, অনিরুদ্ধ বসে পরে আরমকেদাড়ায়। থুতনিতে হাত দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে দেখতে থাকে বন্দিতাকে। হঠাৎ খেয়াল হয়, তার মতো হেটে হেটে পড়ার অভ্যাস করেছে বন্দিতা। তার এলো চুল দুলছে কোমরের কাছে, সিঁথির সিঁদুর ও কপালের টিপটা ফিকে হয়ে গেছে সারাদিন পর। চোখের কাজল গড়িয়েছে সারাদিনের পরিশ্রমে, কিন্তু চোখে যে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় তা সারাদিনের ক্লান্তিতেও মেটেনি। বন্দিতা মন দিয়ে পড়তে থাকে আর অনিরুদ্ধ অপেক্ষা করে তার উপদেশের জন্য। হাতটা থুতনিতে ভর দিয়ে টেবিলে রাখতে গিয়ে হুমড়ি খায় সে। যখন পেপার ওয়েটটা তার হাতের ধাক্কায় ভূলুণ্ঠিত হয়, তখন অনিরুদ্ধের বোধ হয় সে এক দৃষ্টে চেয়ে ছিল স্ত্রীয়ের দিকে। ভয় ভয় তাকায় সে বন্দিতার দিকে, তার পেপার ওয়েটের আওয়াজে তাকিয়েছে সে, কিন্তু সে খেয়াল করেনি ঠিক কতক্ষন তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে ছিল তার স্বামী। অনিরুদ্ধ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
“ও কি? ওটা পরে গেল কি করে?” জিজ্ঞেস করে তুলে দেয় তার হাতে বন্দিতা ।
“অন্যমনস্ক ছিলাম বোধ হয়।” তার দিক থেকে মুখ সরিয়ে বলে অনিরুদ্ধ।
“কোথায় যে আপনার মন থাকে!”
“তা তুমি জানলে আমার রক্ষে ছিল না।”
“কি বললেন?”
“কিছু না।”
“কিছু বললেন যে, আমায় বললেন?”
“না তোমায় বলিনি, নিজেকে বলেছি।”
“একা একা কে কথা বলে?” ভ্রূকুটি করে বন্দিতা। অনিরুদ্ধ জানে তখন তার মন অন্যদিকে না ফেরালে প্রশ্নবান আসবে তারই দিকে।
“বলো কি বুঝলে, ঘুম পেয়েছে আমার।”
“তাহলে শুনুন।” হাত নেড়ে তার বক্তব্য জানায়ে বন্দিতা, এক মনে তার দিকে তাকিয়ে শুনতে থাকে অনিরুদ্ধ। সব কথা তার মাথায় ঢোকে না। বন্দিতা তার চাহুনিতে ভুলে যায় সে কি বলছিল, আমতা আমতা করে আবার শুরু করে নিজের বক্তব্য। নিজের মনেই হাসে অনিরুদ্ধ। স্ত্রী অবুঝ হলেও তার চাহনিতে কি বলছে সেটা ভুলে গেলে মন্দ লাগেনা তার। বন্দিতার মতো মেয়েকে এক দৃষ্টিতে চুপ করতে পারা কি কম সৌভাগ্যের কথা?
Comments
Post a Comment