জমিদার গিন্নি
ENGLISH TRANSLATED VERSION HERE
তবে জমিদার বাড়ির বড় গিন্নি বন্দিতা কে দেখে উমা ঠাকুমার সুর যেন অন্য রকম।
“ঈয়ে .. মানে ও বৌমার নিজের পিসির মেয়ে কিনা তাই.. “ ইতস্তত করে বলেন বাড়ির গিন্নি।
“জমিদারের বউ, তাই লোকে সাহস করে দু’চার কথা বলেনা কিন্তু বিয়ে তো হল অনেকদিন।” উমা ঠাকুমা চোখের কোন দিয়ে দেখলেন কেমন দেবতার আগমনে সরগোল পরে গেছে। সম্পূর্ণার দিকে আর কারো দৃষ্টি নেই।
“তা বাচ্চাকাচ্চা তো হলনি । অমন মেয়ের দৃষ্টি যদি তোমার ঘরের কুলদীপের উপর এসে পরে তা কি ভাল হবে বাছা?” বাঁড়ুজ্জে গিন্নি কেমন জানি ভয় পেল। কথা তা তো নেহাত ভুল না। যেমন করেই হোক না কেন, বিয়ে তো হয়েছে একই দিনে, অনেক বছর হল বই কি। হন্তদন্ত করে অতিথি সৎকার করতে গেলেন তিনি। মনের আশঙ্কা প্রকাশের অবকাশ নেই তার।
দামি তসরের উপর কাঁথার কাজ করা হলদে লাল শাড়ী পরে যিনি সম্পূর্ণার সম্মুখে এসে দাড়িয়েছেন , এই সব আলোচনা যাকে ঘিরে, সেই বন্দিতার বয়েস ষোলোর বেশি হবেনা। উমা কাকিমা বিদ্রুপ করলেও এই ক’বছরে তুলসীপুরের গ্রাম ও মানুষের কাছে তাদের ছোট মালকিন বন্দিতা সত্যি করে হয়ে উঠেছে ভগবান তুল্য । জমিদার বাড়ির একমাত্র গিন্নি হয়েছে সে, মাত্র আট বছর বয়েসে দুই মাতৃহীন ঠাকুরপোর বন্ধু হয়েছে সে। গ্রামের মানুষের সুবিধা অসুবিধা শুনে নির্দ্বিধায় জমিদার ত্রিলোচন রায় চৌধুরীকে জানায় সে। সম্পর্কে তিনি তার জ্যাঠা শ্বশুর হলেও বদ মেজাজি জমিদার বাবু তার “মা” ডাকা এই বৌমাটির নালিশ ছেলের মত চুপ করে শোনেন বটে। সারা গ্রাম জানে সে কথা। তাই তাদের সুখে দুখে পাশে দাড়ান এই জমিদার গিন্নি ভগবান না হলেও মাতৃতুল্য বটেই। সেই যে সেবার যখন দত্তদের মেয়ের বিয়ে প্রায় জন্য ভেঙে যেতে বসেছিল, নিজের হাতের বালা নির্দ্বিধায় খুলে দিয়ে তাদের উদ্ধার করেছিল বন্দিতা, আশাও করেনি যে তারা তার ঋণ শোধ করবে। বলেছিল এই কথা যেন জমিদারবাবু জানতে না পারেন।
বন্দিতার পড়াশুনা নিয়ে সে কি কম ঝামেলা দেখেছে তুলশিপুর? এই যে সম্পূর্ণার শ্বশুরমশাই , জমিদার বাড়ির খাজাঞ্চী, উনিই তো বলেছেন এসে সবাইকে রসিয়ে রসিয়ে সেসব ঘটনা। বাপ ছেলের সে কি ঝগড়া, কাক চিল বসার যো নেই । তা বিয়ে করেছিস কর, গরিবের মেয়ের উপকার করেছিস, জাত কুল বিদেশেই বর্জন করে এসেছিস, তা বলে এমনটা কি কেউ কোনো দিন শুনেছে? বাড়ির বউ কিনা ইস্স্কুল যাবে, ইংরিজি শিখবে, তাও আবার তুলসীপুরের জমিদারবাড়ির বড় বউ?
অনিরুদ্ধ বাবু কি বিলেত থেকে ফিরে পাগল টাগল হলেন নাকি? তা এখানে যা গরম ওনার সয় না বোধ হয়। এমন রসিকতা ও সরগোল বেঁধেছিল পঞ্চায়তের মোড়লদের গড়গড়ি টানা আড্ডাখানায়ে। তা কেউ যা কোনদিন ভাবেনি তাও হল। বন্দিতা শাড়ী জুতো মোজা পড়ে জমিদারদের ফিরিঙ্গি গাড়ি চড়ে স্কুলেও গেল, স্বামী নিজে তাকে নিয়ে গেলেন সর্বসম্মুখে। আবার অনিরুদ্ধ বাবুর তাগিদে আর বন্দিতার শিক্ষায় তুলসীপুরেও ক’বছরের মধ্যেই খুলে গেল মেয়েদের ইস্কুল। তাতেই তো কাজ করে সম্পূর্ণার দেওর।
“তা বাপু এতই যে ঢলানি দেখি কত্তা গিন্নির” হেসেই বললেন মিত্র বাড়ির ছোট বউ, “তা একটা সন্তান হচ্ছেনা কেন?” তার কথায়ে অনেকেই সায় দিল। “বলি গরিবের মেয়ের কোন দোষ ঢাকতে এই পড়াশুনার অজুহাত?”
“আমি তো শুনেছি আধা সপ্তাহ সেই কলকাতায় পরে থাকেন উনি, তা সেখানে কি মধু আছে কে জানে?” উমা ঠাকুমা গলা নামিয়ে বলল। তাদের সকলের চোখ বন্দিতার দিকে, কি যেন উপহার এনেছে সে দিদির জন্য। সম্পূর্ণা ধরতে গেল কিন্তু তার শাশুড়ি তা আগেই ছিনিয়ে নিয়ে, জমিদার গিন্নিকে বসতে দিলো আসন পেতে।
“আরে, ও বউ, তুমি দেখি কিছুই জানো না!” বলে উঠল মিত্তির গিন্নির শাশুড়িমা, “উনি যে উকিল! কাজে যান হয়তো।”
“তুমি থামো তো গিন্নি।” উমা ঠাকুমা আবার বিদ্রুপ করলেন “ শাশুড়ী হয়ে গেলে তাও বুদ্ধিশুদ্ধি হলোনা। তা রোজ রোজ কলকাতা তে কাজ থাকলে বউকে নিয়ে গেলোনা কেন ওখানে? অনেকেই যে যায় আজকাল কলকেতে থাকতে।”
“আহ! তাহলে ওই কচি গ্রামের মেয়েগুলোর মাথা খাবে কি ভাবে শুনি? তারা নাকি পড়ে মহা দিগ্বজ হবে, দেশ উদ্ধার করবে।” হঠাৎ হেসে উঠলেন সকলে।
বন্দিতা মেঝের দিকে চেয়ে মন দিয়ে শুনছিল সম্পূর্ণার কথা, জামাই বাবু মামাকে চিঠি পাঠিয়েছে, তারা আসবে মেয়ে কে দেখতে। তার শ্বশুরমশাই রাজি থাকলে নিয়ে যাবে তাকে বাড়িতে। কতদিন বাড়ি যায়নি বন্দিতা। বন্দিতার মা আসবে কি? বিধবাদের তো আবার শুভ কাজে আসা নিষেধ। অনেকদিন মা কে দেখেনি সে। কিন্তু সে কথা জিজ্ঞেস করা কি উচিত? বন্দিতা জানে জামাইবাবু কাজ করে ব্যারিস্টার বাবুর কাছে। তার যে কোন জিজ্ঞাসাকে আদেশ ভাববে এরা। হয়তো জামাইবাবু লিখে জানাবে মামাকে। মামীর টিকিটে আসবে মা। সম্পূর্ণা দিদির এখন মামীকে বেশি দরকার। হঠাৎ হাসির শব্দে তাকায় সেদিকে। তাকে চাইতে দেখে মহিলারা এমন হাবভাব করতে লাগলেন যেন তাকে সেখানে প্রথম দেখলেন তারা।
“আরে , জমিদার গিন্নি যে, ভালো তো?” বন্দিতা একটু হেসে মাথা নাড়ে । সে জানে এরা তার ভালো জানতে চায়না । এদের সবার মুখ তার চেনা, চরিত্র জানা। দূরে বসে সে বলে দিতে পারে এরা কার বিষয় কি কথা বলছিল। কিন্তু থাক সে সব কথা। প্রয়োজন পরলে সে তাদেরও শুনিয়ে দিতে পারে, শুনিয়েছেও বহুবার। আজ নয়। আজ শুধু সম্পূর্ণা দিদির বোন সে এখানে। এদের শুনিয়েও বা কি লাভ। ব্যররিস্টার বাবু বলেন, কিছু লোকের কথায় কান না দেওয়াটাও বুদ্ধিমানের লক্ষণ, বুঝলে বন্দিতা? বন্দিতার হঠাৎ হাসি পেল । উনি এখানে থাকলে তাদের সাথে দক্ষ যজ্ঞ বেঁধে যেত। তাহলে কি তার বুদ্ধি ওনার থেকে বেশি? নিজের ভাবনায়ে হেসে ফেলে বন্দিতা।
“কিরে, হাসছিস কেন?” সম্পূর্ণার কথায়ে আচমকা তাকাল বন্দিতা। তার দৃষ্টিতে বরাবরই বুদ্ধিমত্তার ছোয়া । সম্পূর্ণা অনেকবার শুনেছে নিজের শাউড়ি মা বা স্বামীর থেকে বন্দিতাকে আপনি আজ্ঞে করতে, ছোট থেকে দেখে আসা বোনটির জন্য সেসব সম্বোধন আসেনা তার। বন্দিতা বা জামাইবাবু জমিদারবাড়ি বা এই গ্রামের অন্যদের মতন বিশ্বাস করেনা শ্রেণী বিভাগে। তাই বোধ করি সম্পূর্ণার সুবিধাই হল।
“আমি উঠি।” হঠাৎ বন্দিতার কথায়ে তার হাত আলতো করে চেপে ধরলে সম্পূর্ণা। জোর সে করতে পারেনা। বন্দিতা শুধু তার বোন নয়, মনিব ও বটে। সেটা অস্বীকার করার মতন ক্ষমতা তার নেই।
“সে কি! খাবিনা ? আমার সাধ পূরণ দেখবি না?” জিজ্ঞাসা করে সম্পূর্ণা। ম্লান হেসে ফেলে বন্দিতা, “আমি যতক্ষণ আছি, তোমার তো অনুষ্ঠান হবে না গো দিদি, আমি যাই।”
“বন্দিতা শোন , আসলে এরা …”
“থাক না দিদি, আবার আসব একদিন। ব্যারিস্ট্রা বাবু বলেছেন কলকাতা নিয়ে যাবেন একদিন আমাকে, তোমার জন্য কিছু জিনিস নিয়ে আসব। মামারা এলে ওবাড়ী যেতে বোলো, কেমন?” সম্পূর্ণার চোখ ছলছল করে, তা হয়তো শুধু বন্দিতা দেখে। হাতে হাত রেখে সরিয়ে নেয় সে।
“আমি যাই আজ দিদি, অনেক বেলা হলো, সবাই বসে থাকবে। কেউ তো খায়না আমি ভাত বেড়ে না দিলে, উনিও এলেন বলে।” হন্তদন্ত করে উঠে পড়ল জমিদার গিন্নি।
Comments
Post a Comment