প্রকাশ
অনিরুদ্ধ শুনেছে তার বাবা মাঝে মধ্যেই যাতায়াত করেন এমন মজলিসে। তার জানার প্রবল ইচ্ছা যে কেমন হয় এই আসর। বন্ধুদের মুখে সে শুনেছে, বাঈজীরা নাকি অপরূপ সুন্দরী, যেমন তাদের গানের গলা তেমনি কত্থক নৃত্যপরিবেশনা। কিন্তু তুলশিপুরে যদি কেউ জানতে পারে সে আসরে গেছে? জ্যাঠামশাই ক্ষুব্ধ হবেন। ছোট ভাইয়ের এই রুচি পছন্দ করেননা তিনি। তার উপর অনিরুদ্ধ মদ্যপানের থেকে দূরে থাকে। এইসব আসরে সেটাই আসল।
“না না তোমায় ওসব করতে হবেনা।” জোর দিয়ে বলে শেখর। “তুমি যাবে, দেখবে, শিখবে, এই আর কি। বুঝলে ভায়া, এটাও একটা অভিজ্ঞতা।” রাজি হয় অনিরুদ্ধ, মনে মনে ভাবে বন্দিতাকে বলবেনা সে কোথায়। পার্টি আছে বললে বেশি প্রশ্ন করেনা সে, রাতটা থেকে যাবে শেখরের বাড়িতেই। শেখর গোপনে নিজের পরিকল্পনাকে রূপ দেওয়ার কথা ভাবতে থাকে।
চিতপুরের মোড়ের থেকে একটা গলি চলে গেছে। সেখানে থামে ভাড়া করা টাঙ্গা। তার ভাড়া মিটিয়ে শেখরের পেছনে পেছনে যায় অনিরুদ্ধ। শেখরের কোথায় প্যান্ট শার্ট পরে বাঈজী বাড়ি আসা চলেনা। তাই পরনে আজ ধুতি পাঞ্জাবি। অনিরুদ্ধ বাড়িতে বলে এসেছে তার নেমন্তন্ন আছে কলকাতায়। বন্দিতা তার টাকার থলি, পারফিউম রুমাল এগিয়ে দিয়েছে হাতের কাছে। একটাও প্রশ্ন করেনি স্বামীকে। তার বিশ্বাসে আজ কেমন শ্বাসরুদ্ধ লেগেছে অনিরুদ্ধের। বেরিয়ে এসেছে সে হন্তদন্ত করে বাড়ি থেকে। শেখর থামে একটি বাড়ির সামনে। ভেতর থেকে বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। দু ধাপ সিঁড়িতে টিমটিমে আলো। হঠাৎ এক মহিলা সেখানে এসে শেখরকে দেখে জিজ্ঞাসা করে “তবে কি এই নতুন বাবুকে আনলেন আজ?”
“ও আমার বন্ধু।” মহিলার দৃষ্টিতে অস্বস্তি বোধ করে অনিরুদ্ধ। “ওবাবা, উনি দেখি লজ্জায় লাল।” হেসে ওঠে মহিলা। এগিয়ে দেয় একটা বেলের মালা। শেখর নিজের হাতে বেঁধে নেয়, অনিরুদ্ধ তার দেখাদেখি তাই করে। তার পর মহিলার পেছনে পেছনে চলে যায় তিন তলায়। সেখানে একটি মেয়ে হঠাৎ তাদের গায়ে গোলাপের সুগন্ধি আতর ছড়িয়ে দেয়। অনিরুদ্ধের সেই তীব্র গন্ধে যেন মাথা ধরে। আসর বসে একটা বিশাল ঘরে, প্রথমে একজন গান করেন, উনি প্রধান বাঈজী, তারপর আসে নৃত্য পরিবেশনা। সত্যি বলতে মন্দ লাগেনা অনিরুদ্ধের। হিন্দুস্থানের কত রাগ, কত নৃত্য কত অজানা সম্ভার যেন টিকে আছে এই বাঈজীদের বাড়িতেই। তারা যে কারণেই এসব করুক না কেন, তাদের শিল্পকে যে তারা সম্মান করেন তা বলে দিতে হয়না। মধ্যরাত্রে হাতঘড়ি দেখে অনিরুদ্ধ। শেখর তখন মদ্যপানে ব্যস্ত।
“বলছি, এবার ওঠা যাক?” কানের কাছে মুখ নিয়ে শেখরকে প্রশ্ন করে অনিরুদ্ধ। হেসে ফেলে শেখর। “দাঁড়াও বন্ধু, তোমার জন্য এক বিশেষ আয়োজন করেছি যে।” শেখর টলতে টলতে অনিরুদ্ধকে নিয়ে যায় পাশেই আর এক কোঠি বাড়িতে। অনিরুদ্ধ তাকে একা ছাড়তে পারবেনা বলেই যায় সাথে। সেখানে প্রায় তার বয়েশি একটি মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় শেখর। টাকা দেয় তাকে। পরনে তার বেনারসী শাড়ী, গায়ে গয়না। যেন নতুন বউ সে।
“যাও দেখি এর সাথে, আমি আসছি।” শেখর বলে অনিরুদ্ধ কে।
“কোথায় যাব ?” প্রশ্ন করে অনিরুদ্ধ। মেয়েটি হেসে এগিয়ে আসে, “ভয় কি বাবু, আমি কি তোমার ক্ষতি করব?” কিছু বলার আগে অনিরুদ্ধের হাত ধরে একটি ঘরে ঢোকে মেয়েটি। দরজা বন্ধ করে দেয়।
“এ কি? কি করছেন?” প্রতিবাদ করে অনিরুদ্ধ।
“যা করতে বলেছেন আপনার বন্ধু।” হেসে তার গায়ে নিজের মাথার মালাটা ছুড়ে দেয় মেয়েটি। “আপনার নাকি এত বয়েসেও কোন অভিজ্ঞতা নেই?” হাসে সে। অনিরুদ্ধর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এই জন্য এনেছে তাকে শেখর? তার কথার এই তাৎপর্য করেছে সে? “বউ আছে বাড়িতে? না নেই?”
“আছে।” কেন জানেনা অনিরুদ্ধ উত্তর দেয়, মেয়েটিকে অসম্মান করতে চায় না সে। মেয়েটি হাসে, “বয়েস কম বুঝি?” হঠাৎ বন্দিতার মুখটা মনে পরে তার। আর দাড়াতে পারেনা সেই ঘরে। যেন তাদের সম্পর্ককে অসম্মান করছে সে। অনিরুদ্ধ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, জানতেও চায় না শেখর কোথায়। হন্তদন্ত করে রাস্তায় এসে জুরিগাড়ি ধরে সে। ভাবতে থাকে, সে ভুল না শেখর? তার বয়েসে শেখরের মতো কিছু প্রয়োজন থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই প্রয়োজন পূরণের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে বন্দিতার বিশ্বাস। সে ছোট হতে পারে, কিন্ত তার বিবাহ করা স্ত্রী। তাদের সম্পর্ক কেমন তা জানার পরিপক্কতা এগারো বছরের বন্দিতার না থাকলেও অনিরুদ্ধের আছে। সে পারেনা বন্দিতার সাথে জেনে বুঝে কোন অন্যায় করতে। কি হত যদি ক্ষণকালের জন্য শেখরের কথা শুনে নিজের আবেগের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারাতো অনিরুদ্ধ? নিজেকে কি কোনদিন ক্ষমা করতে পারত? হয়ে উঠতে পারত আবার বন্দিতার যোগ্য? আর এইসব বন্দিতা জানতে পারলে, বুঝতে শিখলে, তার প্রতি সম্মান কমে যেত না? প্রথমবার নিজের কর্মফলে স্ত্রীকে হারানোর ভয় হয় অনিরুদ্ধর মনে।
অনিরুদ্ধ যখন বাড়ি ফেরে, বন্দিতা তখন খাটে বসে পড়ছে। হঠাৎ তাকে দেখে উঠে দাড়ায় সে, “আপনি?” মুখে তার চিন্তার প্রতিচ্ছবি। “আপনার তো কাল আসার কথা ছিল। শরীর খারাপ নাকি?” হঠাৎ তার সরল মনের প্রশ্নে আবিষ্ট হয়ে তাকে আলিঙ্গন করে অনিরুদ্ধ। অবাক হয় বন্দিতা। সে ভয় পেলেই একমাত্র এমন ভাবে আঁকড়ে ধরে অনিরুদ্ধকে। অনিরুদ্ধকে সে কখনো দেখেনি এমনটা করতে। তবে কি কিছুতে ভয় পেয়েছেন তিনি?
“আপনিও কি কিছুতে ভয় পেয়েছেন?” প্রশ্ন করে বন্দিতা। তার মাথায় হাত রেখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিরুদ্ধ।
“খুব ভয় পেয়েছি, এরকম আগে কোনদিন পাইনি।” তার মাথায় হাত রেখে বলে অনিরুদ্ধ।
“আপনি যে সব চেয়ে সাহসী?” অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসের সঙ্গে প্রশ্ন করে বন্দিতা।
“যে যতই সাহসী হোক" তার উচ্চতায় নিজেকে সামান্য নিচু করে বলে অনিরুদ্ধ, “কিছু মূল্যবান জিনিস হারানোর ভয় সবার থাকে।” তার কথার অর্থ বুঝবেনা জেনেই হয়তো বন্দিতাকে অনায়াসে বলে অনিরুদ্ধ তার মনের কথা। বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে বন্দিতা।
“চিন্তা করবেননা ব্যারিসট্রা বাবু। আপনার কোনো মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলতে দেবেনা বন্দিতা।” তার আশ্বাসে প্রাণ ফিরে পায় অনিরুদ্ধ।
পরের দিন telegram করে জানিয়ে দেয় সে শেখরকে, তুলসিপুর তার আসা হবেনা।
Comments
Post a Comment